Taimur 1

আজ থেকে সাড়ে পাঁচশ বছর আগে একজন মানুষ গোটা বিশ্ব শাসন করার মিশন শুরু করেছিলেন। যার সম্বল বলতে ছিল  কিছু গবাদি পশু আর মধ্য এশিয়ায় কিছু জমিজমা। আলেকজান্ডারের মত যেমন কোন রাজার পুত্র তিনি ছিলেন না তেমনি ছিলেন না চেঙ্গিস খানের মত কোন গোত্র প্রধানের উত্তরাধিকারী না হয়েও তারপরও তিনি তার মিশনে সফল হয়েছেন। জয় করে নিয়েছিলেন অর্ধেক পৃথিবী। এই জয়ের পথে ধ্বংস করে দিয়েছেন কত শহর, কত জনপদ। তার সেনারা যে স্থানই জয় করত সেখানেই ধ্বংসযজ্ঞের প্রলয় তুলত। এই সৈন্যদলের হাতে ১ কোটি ৭০ লাখ মানুষ নিহত হয়েছিল, যা ছিল সেই সময়ের পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার শতকরা পাঁচ ভাগ। এজন্য তার আর এক নাম ‘নিষ্ঠুর শাসক’ বা জগতের ত্রাস।

 

বলছিলাম বিশ্বজয়ী তৈমুর লংয়ের কথা। ধারণা করা হয়, ১৩২০ থেকে ১৩৩০ দশকে তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন কেশ নগরীর স্কারদু শহরে যার বর্তমান নাম শহর-ই-সবজ বা সবুজ শহর। এই বীর যোদ্ধাকে নিয়ে প্রচলিত রয়েছে নানা কাহিনী বা মিথ। এগেুলোর অন্যতম হচ্ছে তার কবর উত্তোলনের কাহিনীটি। এখানে আমরা সেটি জানার চেষ্টা করব।

 

তৈমুরের মৃত্যুর কয়েক শ বছর পরের ঘটনা।  ১৯৪১ সাল। সোভিয়েত ইউনিয়ন সরকার কবর থেকে তার  মৃতদেহ তোলার সিদ্ধান্ত নিল। উদ্দেশ্য দেহাবশেষ থেকে তার সত্যিকারের চেহারার ছবি আঁকা। কোন কঙ্কাল বা দেহাবশেষ থেকে সেই ব্যক্তিটি জীবদ্দশায় দেখতে কেমন ছিল তার চিত্র অংকন করার বিজ্ঞানটি ইতিমধ্যেই সোভিয়েত ইউনিয়নে যথেষ্ট উন্নতি লাড করেছিল। এটা প্রথম করেছিলেন সোভিয়েত প্রত্নতত্ববিদ ও নৃবিজ্ঞানী মিখাইল গেরাসিমভ।  তিনি সবমিলিয়ে দুই শত জনেরও বেশি মানুষের দেহাবশেষ থেকে তাদের চেহারা অঙ্কন করেছিলেন। তারই নেতৃত্বে একটি টীম গঠন করেন সোভিয়েত শাসক জোসেফ স্তালিন।

 

কিন্ত সমস্যা হচ্ছে তাকে কোথায় সমাহিত করা হয়েছে তার কোনো হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। একের পর এক কবর খুঁড়েন আর হতাশা বাড়ে গেরাসিমোভ ও তার নৃবিজ্ঞানী দলের। অবশেষে  তারা সমরকন্দের একটি স্থান চিহ্নিত করলেন। তারা এক প্রকার নিশ্চিত যে, এটিই হচ্ছে তৈমুরের আসল কবর।

 

Taimur 2

 

তারা কবর খুঁড়তে শুরু করলেন। কিন্তু খোড়াখুঁড়ির পর আগের চাইতেও বেশি হতাশ হলেন নৃবিজ্ঞানীরা। এটিও  শূণ্য কবর। হতাশ গেরাসিমভ এবার গভীর চিন্তায় মগ্ন হলেন। হঠাৎ বিদ্যুৎ খেলে গেল গেরাসিমোভের মাথায়। ‘আমরা থেমে গেলাম কেন? আরো গভীরে খুঁড়িনা। দেখিনা, কি আছে সেখানে।’

 

পরদিন নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করলেন। কবরের অনেক গভীরে গিয়ে ভারী কয়েকটি পাথরের পাটাতন নজরে পড়ল।  পাটাতন সরানোর প্রস্তুতি নিচ্ছেন, এরকম সময়ে গেরাসিমোভের কাছে সংবাদ এলো, তার সঙ্গে তিনজন বুড়ো দেখা করতে চান। কাজ রেখে বাইরে বেরিয়ে এলেন গেরাসিমভ। কাছেই ছিল একটি চাইখানা (মধ্য এশিয়ায় প্রচলিত বিশেষ ধরনের অতি জনপ্রিয় চায়ের ক্যাফে)। সেখানেই অপেক্ষা করছেন তিন বুড়ো। তিনি সেই চাইখানায় গেলেন তাদের সঙ্গে দেখা করতে। প্রাচীনকালের রূপকথার মত দেখতে তারা। ঠিক যেন মায়ের পেটের তিন যমজ ভাই। তারা রুশ ভাষা জানত না। ফার্সিতেই কথা বলতে শুরু করল। এক অনুবাদক তর্জমা করে শোনায় গেরাসিমভকে।

 

তারা গেরাসিমভকে তৈমুরের মৃতদেহ তুলতে বারণ করলেন। জবাবে ওই রুশ বিজ্ঞানী বললেন,‘সোভিয়েত ইউনিয়নের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী স্বয়ং স্তালিন আমাদের পাঠিয়েছেন। মিশন শেষ না করে যাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না।’ ক্ষেপে গিয়ে বৃদ্ধরা বললেন, ‘সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী উপরওয়ালা, স্তালিন নয়। তার কথা না শুনলেও চলবে।’ তিনি তখন জানতে চাইলেন,  সামান্য একটা মৃতদেহ তুলতে তাদের অতআপত্তি কিসের। জবাবে তারা বললেন,‘এটি  তৈমুর লং-এর মৃতদেহ। আপনাদের স্তালিনের চাইতেও যিনি বহু গুণ ক্ষমতাধর শাসক ছিলেন। তাই ভয়াবহ কিছু ঘটে যাওয়ার আগেই আপনাদের শাসককে থামান।’

 

এরপর তারা আরবিতে লেখা অতি প্রাচীন একটি বই দেখালেন। বইয়ের একটি জায়গায় আঙুল দিয়ে দেখিয়ে শান্ত সৌম্য তৃতীয় বৃদ্ধটি বললো,‘এই দেখ, এখানে লেখা,  তৈমুর লং-এর ঘুম ভাঙালে পৃথিবীতে এমন একটি রক্তাত ও ভয়াবহ যুদ্ধ শুরু হবে যা মানব জাতি ইতিপূর্বে কখনো দেখেনি।’

 

এসব কুসংস্কারে বিশ্বাস করার মানুষ নয় আধুনিক চিন্তাধারায় বিশ্বাসী গেরাসিমভ। তিনি অটল রইলেন নিজের সিদ্ধান্তে। ফিরে গেলেন গোর খননের কাজে। দিনটি ছিল ১৯৪১ সালের ২০শে জুন।

 

Taimur 3

 

কিন্তু কি আশ্চর্য! তৈমুরের সমাধির গায়ে এটি কি লেখা! ফারসি ও আরসি ভাষায় লেখা, ‘আমি যেদিন জাগব, সমগ্র পৃথিবী প্রকম্পিত হবে (“When I rise from the dead, the world shall tremble.”)। যত্ত সব কল্প কাহিনী! অবশেষে ১৯৪১ সালের ২২শে জুন সমাধির পাটাতন সরিয়ে ওঠানো হল কফিন। গভীর আগ্রহ নিয়ে কফিনের ডালা খুললেন গেরাসিমভ। কফিনে শায়িত পাঁচশত বছর আগে পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়া, মহাশক্তিধর তৈমুরের নিথর-নীরব দেহ। মৃতদেহের পাশে ওটা কি পড়ে আছে? ফলকটি  হাতে তুলে নিলেন গেরাসিমোভের। সেখানে লেখা, ‘যেই আমার কবর খুলুক না কেন, সে আমার চাইতেও ভয়াবহ এক আগ্রাসীকে পৃথিবীতে ডেকে আনলো (Who ever opens my tomb, shall unleash an invader more terrible than )।’

 

মন খারাপ হয়ে গেল গেরাসিমোভের। তবুও তৈমুরের দেহাবশেষ নিয়ে গভীর মনযোগের সাথে কাজ চালিয়ে গেলেন। তিনি দেখেন, তৈমুর বেঁটে বলে যে ধারণা প্রচলিত রয়েছে তা সত্য নয়। তিনি ৫ ফুট ৮ ইঞ্চি লম্বা যা তার যুগের মানুষদের গড় উচ্চতার চেয়েও বেশি। তবে তার এক পা খোঁড়া। কোনো এক যুদ্ধে আঘাত পাওয়ার পর তিনি খোঁড়া হন।

 

গেরাসিমোভ যেদিন তৈমুরের মৃতদেহ নিয়ে গবেষণা শুরু করেন সেদিনই জার্মানির হিটলার বাহিনী হামলা চালায় সোভিয়েত ইউনিয়নে। দুনিয়া তোলপাড় করা যে অভিযানের নাম অপারেশন বারবারোসা। পৃথিবী কি তাহলে নতুন সন্ত্রাসীর পদভারে কাঁপছে?  বিংশ শতাব্দির ত্রাস এডলফ হিটলারই কি তৈমুরের চাইতেও ভয়াবহ সন্ত্রাসী!

 

খবর শুনে হতবাক হয়ে গেলেন গেরাসিমোভ। এটা কি শুধুই কাকতালীয়! তার বিজ্ঞানমনস্ক মন নড়ে ওঠল। মনে পড়ে গেল, কবরের  গায়ের লেখা বাক্যটি। ‘যেই আমার কবর খুলুক না কেন, সে আমার চাইতেও ভয়াবহ এক আগ্রাসীকে পৃথিবীতে ডেকে আনলো। তিনি ছুটে গেলেন ওই চাইখানায়। কিন্তু এর মালিক জানালেন, ওই তিন বৃদ্ধকে তিনি আর কোনোদিন দেখেননি। ওইদিনই প্রথম এবং ওইদিনই শেষ। এবার প্রবীণদের উপদেশ অগ্রাহ্য করায় অনুশোচনা হল গেরাসিমভের। তিন বৃদ্ধের অনুরোধ ও সাবধান বাণী, কবরের লেখা, কফিনের ভিতর ফলকের লেখা, কিছুই গ্রাহ্য না করাতেই  রাশিয়ার অত বড় সর্বনাশ ঘটে গেল। তিনি এর প্রায়শ্চিত্য করতে চাইলেন। স্তালিনকে ফোন করে পুরো ব্যপারটা খুলে বললেন। তিনি গেরাসিমভকে তৈমুরের মুখচ্ছবি গড়ার নির্দেশ দিলেন।

 

Taimur 4

 

প্রভুর নির্দেশ পেয়ে কাজ শুরু করলেন গেরাসিমোভ। কিন্তু মনের খুঁতখুতানি কিছুতেই দূর করতে পারছেন না । সারাক্ষণ অনুশোচনায় ভোগেন। কিন্তু কাজ বন্ধ করলেন না। অবশেষে প্রকাশিত হলো তৈমুরের চেহারা।  বিশ্ববাসী প্রথমবারের মতো দেখলো লৌহমানব (চাঘতাই ভাষায় তৈমুর শব্দের অর্থ লৌহ) তৈমুরের কঠিন মুখচ্ছবি।

 

এদিকে রাশিয়ার অভ্যন্তরে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ তখন ভয়াবহ রূপ ধারন করেছে। বিংশ শতকের ত্রাস হিটলার বাহিনীর কাছে একের পর এক যুদ্ধে পরাজিত হচ্ছে সোভিয়েত বাহিনী। তখন তৈমুরের দেহ ফের কবরে ফিরিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন গেরাসিমোভ। ১৯৪২ সালের ২০শে নভেম্বরে পূর্ণ মর্যাদায় ইসলামী রীতি মেনে তৈমুরের মৃতদেহ পুণরায় দাফন করা হয় গুর-ই-আমির সমাধিতে। কি আশ্চর্য, তার দফনের পরপরই স্তালিনগ্রাদ যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে এলো প্রথম আনন্দ সংবাদ। অপারেশন ইউরেনাস-এ হিটলার বাহিনীকে পরাস্ত করেছে সোভিয়েত বাহিনী। এটিই ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের টার্নিং পয়েন্ট।

 

বিশ্বাস করুন, আর নাই করুন এটিই ঐতিহাসিক সত্য। বৈচিত্রময় এই পৃথিবীর কোণায় কোণায় ছড়িয়ে আছে কতই না রহস্য!


আপনার মতামত দিন