পূর্বপ্রস্তুতি সরুপ, করোনা সংক্রমনে মৃতদের জন্যে ইউক্রেন, আয়ারল্যান্ড এখনি গণকবর খুঁড়ছে, আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বলছে মৃতের সংখ্যা ২ লাখের নিচের রাখতে পারলে তারা সন্তুষ্ট আর ইতিমধ্যে ১লাখ মৃতদেহ সৎকারের জন্যে প্রটেকটিভ ব্যাগ প্রস্তুত করছে, ইংল্যান্ড আরো আগেই ১০ লক্ষ মৃত দেহ দাফনের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে, জার্মান চ্যান্সেলর বলছে তাদের ৭০% লোক করোনায় আক্রান্ত হতে পারে এবং এই আশঙ্কাকে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারন করে তা মোকাবেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু কি ধারনার উপর ভিত্তি করে তাদের এই প্রস্তুতির মহাযজ্ঞ?

coronavirus

সবাই জানি যে, বিগত ৩১শে ডিসেম্বর ২০১৯ এ চীন থেকে শুরু হয়ে মহামারি করোনা (Sars-Cov-2 or Covid-19) ভাইরাসের আক্রমন ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের প্রায় সবকটি দেশে। চীন রোগটি মার্চে এসে সামলে নিতে পারলেও এটি সাক্ষাত মৃত্যুদূত হয়ে ঝাপিয়ে পড়েছে ইটালি, স্পেন ও ইরানে। প্রতিদিন হাজার হাজার প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। মার্চের শেষ দিকে জার্মানি ও সমগ্র ইউরোপ দাপিয়ে ভায়ার্ত থাবা বসায় বিশ্বের সামরিক ও অর্থনৈতিক পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উপর। পৃথিবীব্যাপি প্রতিদিন বাড়েছে মৃত্যুর মিছিল। ভেঙে পড়ছে অর্থনৈতিক, যোগাযোগ ও চিকিৎসা ব্যবস্থা। গত ফেব্রুয়ারির শেষ বা মার্চের প্রথম সপ্তাহ থেকে প্রায় প্রতিটি দেশে চলছে ঘোষিত-অঘোষিত জরুরী অবস্থা, লকডাউন। বন্ধ হয়ে গেছে সকল ধরনের শিল্প উৎপাদন ও কৃষি পণ্য পরিবহন ও বন্টন ব্যবস্থা। আশঙ্কা দেখা দিয়েছে বিশ্বব্যাপি দীর্ঘমেয়াদী ভয়ানক খাদ্য ঘাটতির। আর এই দিকে মহামারি করোনা ভাইরাসের সংক্রমন ছড়িয়ে পড়েছে দরিদ্রপিরীত ও জনবহুল বাংলাদেশসহ সমগ্র দক্ষিন এশিয়ায়।

জনসংখ্যার ঘনত্বের কথা বিবেচনা করলে বাংলাদেশের অবস্থান একেবারে শীর্ষে। আছে জনসচেতনতার ব্যাপক অভাব। দারিদ্র, চিকিৎসা সেবার অপ্রতুলতা এবং সর্বক্ষেত্রে দুর্নীতি। এছাড়াও বিশ্বের সবচেয়ে বড় এবং ১০লক্ষ লোকের শরণার্থী শিবির অবস্থিত এদেশের দক্ষিন পূর্বাঞ্চলে।

ইতিমধ্যে গত ৮ই মার্চ প্রথম করোনা সংক্রমন পাওয়া যাওয়ার পর এখন পর্যন্ত (৬এপ্রিল) আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দুই’শতেও পৌছায় নি। অথচ এর ভয়ে ভেঙে পড়েছে দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থা, ডাক্তারগণ পিপিই ও নিরাপত্তার অভাবে সাধারন চিকিৎসা সেবাও বন্ধ করে দিয়েছেন। সাধারন সর্দি-জ্বরেও বিনা চিকিৎসায় রোগী মারা যাচ্ছে। মন্ত্রী ও কর্তাব্যাক্তিগন টিভি-পত্রিকার পাতা থেকে হারিয়ে যাচ্ছেন, প্রশাসনের সর্বস্থরে চলছে সমন্বয়হীনতা, নেই জরুরী অবস্থা, চলছে অকার্যকর লক-ডাওন। সরকার, সচেতন মহল ও মিডিয়াগুলি জনসচেতনতায় ব্যাপক প্রচারনা চালাচ্ছে অথচ এখনো আমাদের ধর্মীয় ও বে-খবর অনেক গুরুত্বপূর্ন ব্যাক্তিবর্গ এটাকে অ-মুসলিমদের উপর আল্লাহ’র গজব হিসেবেই দেখছেন এবং সাধারনের মাঝে মনগড়া বক্তব্য প্রচার করে চলছেন।

অন্যদিকে সবার মাঝে ধারনা জন্মেছে প্রথম কয়েক সপ্তাহ করোনার সংক্রমন সনাক্তকরন পরীক্ষা একটিমাত্র সংস্থার (আইইডিসিআর) এর হাতে কুক্ষিগত করে রাখায় অনেক আক্রান্ত ব্যাক্তি চিহ্নিত না হওয়ায় তারা পরিবার ও সাধারন মানুষের সাথে মিশে রোগটি অনেকের মাঝে ট্রান্সমিট করেছে। অন্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে করোনা পরীক্ষার অনুমোতি দেয়ার পরদিনই ৪ এপ্রিল ৯ জন ও ৫ এপ্রিল ১৮ আক্রান্ত রোগী পাওয়া যাওয়ায় এই ধারনা বাস্তব সম্মত বলেই মেনে নেয়া যায় কারন তার আগে প্রতিদিন আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ২-৩জন করে।

টেষ্ট করে আক্রান্তদের চিহ্নিত করে যথাযত চিকিৎসা দেয়ার মাধ্যমে করোনা সংক্রমন রোধ ও নিয়ন্ত্রন করা সম্ভব যা ইতিমধ্যে দক্ষিন কোরিয়া দেখিয়েছে, জার্মানি মৃত্যুর হার এভাবেই নিয়ন্ত্রন করছে।

ইউরোপ-আমেরিকা এই মহামারিতে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি দেখছে। অবশ্যম্ভাবি মৃত্যুকে তারা আলিঙ্গন করে বাঁচার এবং অন্যকে বাঁচানোর পথ খুঁজতেছে। কোন লুকোচুরি নেই, সত্যকে সবার সামনে তুলে ধরে বাস্তবতার আলোকে প্রতিরোধের চেষ্ঠা করছে তারা। কর্তা ব্যাক্তিদের কথার ঢামা-ঢোল নেই তারা কাজ করছে মানুষের জন্যে। কাজ করে রোগাক্রান্ত হচ্ছে- রানী আক্রান্ত হচ্ছে, রাজপুত্র আক্রান্ত হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী আক্রান্ত হচ্ছে, আক্রান্ত হয়ে রাজকন্যা মারা গেছে। তাদের ব্যবসায়ীগন খাদ্য মজুদ না করে বরং গৃহবন্দী বাসিন্ধাদের ঘরে স্বল্পমূল্যে বা বিনামূল্যে খাবার পোৗছে দিচ্ছে। তাদের পুলিশ, সমাজকর্মী ও দানবীরগন সংবাদে শিরোনাম হওয়ার জন্যে কারো সেবা করে না বরং জনসেবা করে কখনো হয়ত মিডিয়ার চোখে পড়ে। তাদের বিরোধীদল সরকারকে দোষছে না আবার সরকারও বিরোধী দলের ভিতর ষড়যন্ত্রের গন্ধ শুঁকে না। তারা বাঁচতে চায়, সবাইকে বাঁচাতে চায়।

pandemic 1918

আসুন পৃথিবীর ইতিহাসের বড় কয়েকটি মহামারির ঘটনা দেখে নেই যার অধিকাংশই ইউরোপীয় দেশগুলিতে ছড়িয়েছিল। আর আমরাও প্রস্তুত হই ইতিহাসের এই বাস্তবতার আলোকে আসছে আগামী কঠিন দিনগুলির জন্যে।

৫৪১ সাল, (দ্য প্লেগ অব জাস্টিনিয়ান): ৫৪১ খ্রিষ্টব্দে মিশরে শুরু হওয়া প্লেগ মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়লে তাতে আড়াই থেকে দশ কোটি লোক প্রাণ হারায়। আর এই মহামারির স্থায়িত্ব ছিল ৫০ বছর।

১৩৩৪ সাল, দ্য গ্রেট প্লেগ অব লন্ডন: ১৩৩৪ সালে চীন থেকে প্লেগ ইংল্যান্ড ও ইতালিসহ অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়লে সমগ্র ইউরোপ জুড়েই মারা যায় প্রায় আড়াই কোটি মানুষ।

১৩৪৬ সাল, দ্য ব্ল্যাক ডেথ: এটিও ইউরোপ ছড়িয়ে পড়া মহামারি প্লেগ যা শুরু হয় ১৩৪৬ সালে।তবে ব্ল্যাক ডেথের সময় মানুষ কোন রোগটিতে অধিক হারে মৃত্যুবরণ করেছিল, তা নিয়ে ইতিহাসবিদগণ দ্বিধাবিভক্ত। একাংশের মতে, রোগটি ছিল এক প্রকার গ্রন্থিপ্রদাহজনিত প্লেগ। অন্য অংশের দাবি, এ ভয়ানক মহামারী ঘটেছিল ইবোলা ভাইরাসের কারণে।

এর ভয়বহতা এতই প্রকট ছিল যে এটি ১৩৪৭-৫১ পর্যন্ত ৪ বছরেই ইউরোপের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয়। ধারনা করা হয় এর স্থায়িত্ব ছিল ২০০ বছর আর এটির কারনে প্রাণহানি হয় প্রায় দশ কোটি মানুষের।

১৫১৯ সাল, স্মলপক্স এপিডেমিক অব মেক্সিকো : বর্তমান মেক্সিকোতে ১৫১৯ সালে স্মলপক্স ছড়িয়ে পড়লে দুই বছরে মারা যায় প্রায় ৮০ লাখ মানুষ।

১৬৩৩ সাল, স্মলপক্স এপিডেমিক অব আমেরিকা: ফ্রান্স, গ্রেট বৃটেন ও নেদারল্যান্ডসবাসীর মাধ্যমে ১৬৩৩ সালে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটসে স্মলপক্স ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রায় ২ কোটি মানুষ মারা যায় বলে দাবি করেন ইতিহাসবিদরা।

১৮৬০ সাল, দ্য থার্ড প্লেগ প্যানডেমিক: ইতিহাসে সবচেয়ে বিস্তৃত আকারে প্লেগের প্রাদুর্ভাব ঘটে মোটামুটি ৩ বার। তৃতীয়টির উৎপত্তি ১৯ শতকে চীনে, যখন বিশ্ববাণিজ্যে ভালোরকম প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করে দেশটি। ইউয়ান নামক একটি ছোট্ট গ্রামে প্রথম এর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। ক্রমে তা বিস্তার লাভ করতে করতে হংকং আর গুয়াংঝু প্রদেশে ছড়িয়ে পড়ে, যে শহরগুলোর সাথে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরাসরি বাণিজ্য সম্পর্ক ছিল। ফলে প্লেগ ছড়িয়ে যায় ভারত, আফ্রিকা, ইকুয়েডর, এমনকি যুক্তরাষ্ট্রেও। প্রায় দুই দশক স্থায়ী এ মহামারীতে প্রাণ হারায় ১ কোটি ২০ লাখের বেশি মানুষ।

১৯১৮ সাল, স্পেনিশ ফ্লু: ১৯১৮ সালে শুরু হওয়া স্পেনিশ ফ্লু বা গ্রেট ফ্লু নামক মারাত্মক ইনফ্লুয়েঞ্জায় ১৯২২ সাল পর্যন্ত চার বছরে প্রায় ৫ থেকে ১০ কোটি লোক মারা গিয়েছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে কারনে সৈন্যদের মনোবল সতেজ রাখতে ইউরোপ আমেরিকার দেশগুলির সরকার মৃতের সংখ্যা কমিয়ে ২ কোটি দেখিয়েছিল।
এসময় দেশে দেশে সরকার সাধারণ মানুষকে মাস্ক পরিধানের জন্য আইন পাস করে, দীর্ঘদিনের জন্য বড় জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়, খাদ্যদ্রব্যের বাজারগুলোতে লোক সমাগম নিয়ন্ত্রণ করা হতো কঠোরভাবে। ফ্লুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করা মানুষের শবদেহ কাটাছেঁড়া করে ডাক্তাররাও বিচলিত হয়ে উঠতেন। দেখা যেতো, তাদের ফুসফুস নীল এবং স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে থাকতো। মনে হতো যেন তারা পানিতে ডুবে মারা গিয়েছেন।

২০২০ সাল, করোনা সংক্রমন: ২০১৯ সালের ডিসেম্ভরের শেষে চীনের উহান প্রদেশে সামুদ্রিক প্রাণি বিক্রির বাজার থেকে ছড়িয়ে করোনা ভাইরাস। বাজারটি সামুদ্রিক প্রাণির পাশাপাশি বাদুন, বনরুই সহ বিভিন্ন বন্য ও বিষাক্ত প্রাণি বিক্রি করা হয়ে থাকে। গবেষকদের ধারনা বাদুর বা বনরুই থেকেই এই ভাইরাস মানুষের মাঝে ছড়িয়েছে। আবার আমেরিকা-ইংল্যান্ডের অনেকে অনেকের ধারনা চীনের উহানে একটি ভাইরাস বিষয়ক ল্যাবে জৈব অন্ত্র উৎপাদনের জন্যে ভাইরাসটি তৈরী করা হচ্ছিল এবং সেখান থেকেই দুর্ঘটনাক্রমে এটি ছড়িয়ে পড়ে যদি চীন এধরনের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ইতিমধ্যে ১৫ লাখের মত লোক আক্রান্ত হয়েছেন যাদের মধ্যে ৭০ হাজারের বেশি মারা গেছে। প্রতিদিন প্রায় লক্ষাধিক লোকের মাঝে সংক্রমন ঘটছে আর মারা যাচ্ছে হাজার হাজার লোক। এর ক্ষয়ক্ষতির শেষ দেখার জন্যে মানুষকে আরো দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে।

লেখক পরিচিতি
এম, এইচ, মিনহাজ
আমি বিভিন্ন বাংলা/ইংরেজী ব্লগের একজন অনিয়মিত এবং সখের ব্লগার। তবে নিয়মিত লেখার ইচ্ছে থাকলেও অনিয়মিত ভাবেই পাঠকদের বিরক্ত করে থাকি। আমার লেখার বিষয়বস্তু- যা মনে আসে তাই। কারও কাছ থেকে বাহবা পাওয়ার জন্য লিখি না। কেউ আমার লেখা পছন্দ করলে খুশি হই তবে অপছন্দ করলেও লেখালেখি বন্ধ করার কোন অবকাশ নেই, কারন আমি একান্ত সখের বশেই লেখালেখি করি।
আমার ব্লগ সমুহ:

আপনার মতামত দিন