এত দিন আমরা দরিদ্র ছিলাম। সরকার চারদিক দিয়ে উন্নয়নের জোয়ারে ভাসিয়ে, প্রমোশন দিয়ে আমাদেরকে মধ্যবিত্ত জাতি বানিয়েছে অর্থাৎ আমাদের দেশ এখন মধ্যম আয়ের দেশ। বলতে গেলে এখন দেশে কোন অভাব নাই।

অন্য, বস্ত্র, বাসস্থান, চিকিৎসা এসকল মৌলিক চাহিদার বিষয়ে প্রশ্ন তোলারই অবকাশ নেই। বরং দেশের মানুষ বিলাসী না হলেও মধ্যবিত্ত হওয়ার সুবাদে সবাই আয়েশী জীবন যাপন করছে। আপনার বিশ্বাস না হলে সরকারী এবং আমাদের গনমাধ্যমে প্রকাশিত সাম্প্রতিক বানী থেকে আপনি ১০০% নিশ্চিত হতে পারেন । কাগজে কলমেও ব্যাপক প্রমান আছে এর স্বপক্ষে। আপনি অক্সফোর্ডের ডিগ্রীধারী অর্থনিতিবিধ হলেও অবিশ্বাস করার পথ নেই। GDP, GNP প্রবৃদ্ধির হার ইত্যাদি বিশ্লেষন করলেও দেখবেন হিসেব চমৎকার ভাবে মিলে গেছে। সুতারাং আপনাকে তা বিশ্বাস করতেই হচ্ছে আমরা এখন মধ্যবিত্ত।

(বি:দ্র: দেশের রাজাকাররা নাকি তবু এটা মানতে নারাজ। আপনি রাজাকার হয়ে থাকলে অন্যকথা কারন শত-সহস্র প্রমান থাকার পরও আপনি সরকার বিরোধী এবং নেতিবাচক ধারনাতেই অটল থাকবেন)

Jakat Mymensingh 2

 

যাই হোক, সরকারের এই বিশাল প্রমানিত সফলতার জন্য এখনো সরকারকে গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়নি। তার আগেই ঘটে গেল একটি ছোট্ট দূর্ঘটনা। অভাবের তাড়নায় সরকারী খাতার মধ্যবিত্ত মানুষগুলি যাকাত আনতে গিয়ে ময়মনসিংহে গতকাল ১০জুলাই পদদলিত হয়ে ২৭ জন মারা গেছেন। এ আর তেমন কি, মাত্র ২৭ জন মধ্যবিত্ত লোক লাশ হয়েছেন। ছোট্ট ঘটনা। এই ছোট্ট সংখ্যাটাকে মিডিয়ার হাইলাইট করার কিছুই নেই। বরং মধ্যবিত্তদেরকে যাকাত দেওয়ার অপরাধে বেচারা যাকাত দাতা কে আটক করে এবং তার আশপাশের ও নিকটআত্নীয় লোকজনের কি কি অতীত ফাউল আছে তা ১০/১২টি তদন্ত কমিটির মাধ্যমে খুঁজে বেড় করে একটি টাইবুনাল গঠন করে তাদের বিচার করা হওক। এতে করে ভবিষ্যতে আর কেউ মধ্যবিত্ত দেশে যাকাত দেয়ার সহস পাবে না। এমন ছোট্ট দূর্ঘটনাও ঘটবে না।

 

দেশের সর্বত্রই আজ সুখের ছড়াছড়ি। অতি সুখে দেশের মানুষ পাগল হয়ে গেছে। সবাই এখন সুখী হওয়ার আনন্দের জোয়াড়ে উল্টোরথে চলছে। তবুও মিথ্যাবাদীরা বলে "বাঙালী কাজীর গরু শুধু কেতাবেই আছে, গোয়ালে নেই"।

 

jakat mymensingh

 

দূর্নীতি না করলে যে দেশের মন্ত্রীর মন্ত্রীত্ব যায় সে দেশের মধ্যবিত্ত লোকজন ঈদের আগে যাকাত বা সাহায্য আনতে গিয়ে ভীড়ের চাপায় পদদলিত হয়ে প্রান হারাবে এটা কি অস্বাভাবিক । এ দেশে সবকিছুই স্বাভাবিক- বেঁচে থাকার মতই দূর্ঘটনায় মরাও স্বভাবিক, তদন্ত হওয়া স্বাভাবিক, বিচার না হওয়া স্বাভাবিক এবং এসব ঘটনার দায় না নেয়াও স্বাভাবিক।

 

Jakat Mymensingh 5

তবে গতকাল যারা মরা গেছেন তারা অনেক যন্ত্রনা থেকে বেঁচে গেছেন। এই রোজার দিনে আল্লাহ নিশ্চই তাদের শান্তিতে রাখবেন। মধ্যবিত্ত হওয়ার জ্বালা এখন থেকে আর তাদের আর সহ্য করতে হবে না।

 

তাদের রেখে যাওয়া পরিবারের সদস্যদের কথা কি আর বলব। যে বেদনার অশ্রু দিয়ে এই আনন্দের ঈদের করুন সূচনা হচ্ছে সেই ঈদ শেষ হবে। আরও অনেক ঈদ আসবে যাবে কিন্তু মধ্যবিত্ত হওয়ার আজকের এই স্বজন হারানো অশ্রু কোনদিন শেষ হবে না। এই কষ্ট মুছে দেয়ার ভাষা আমাদের জানা নেই।

 

তবুও আমরা আজ গর্বিত মধ্যবিত্ত হতে পেরে । আসুন সবাই গরীব থেকে ধনী হবার আনন্দে ঢাক-ঢোল বাজাই। আমাদের এই নির্লজ্জ আনন্দের ঢাক-ঢোল থামাতে সেই ৭১এর ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর এই মাটির বুক চিড়ে উঠে আসবে না।

 

কিছু দিন পূর্বে শ্রদ্ধেয় লেখক আনিসুল হক স্যার লিখেছেন "আমরা এখন নিম্নমধ্যবিত্ত। এখন আমাদের গম্ভীর হতে শিখতে হবে। কথায় কথায় হাসি-তামাশা করা যাবে না। বড়লোকেরা কম হাসেন। তাঁদের হাসি স্মিত। তাঁরা স্মাইল করেন। মোনালিসার মতো রহস্যময় হাসি হাসেন। আর হ্যাঁ, গরিবদের দেখলে লাফ অ্যাট করেন।"

 

আনিসুল হক স্যারের লেখায় কোথাও ভূল নেই তবে আমার কাছে অসম্পূর্ন মনে হচ্ছে। আমি তো আর লেখক না, তাই হয়ত আমারই বুঝতে ভূল হচ্ছে। হয়ত বাকিটুকু লেখেন নাই অথবা আমার কাছে পৌছায় নাই। তাই বাঁকি টুকু আমার মতে কি হতে পারে দেখুন- "আমরা এখন নিম্নমধ্যবিত্ত। এখন আমাদের গম্ভীর হতে শিখতে হবে। খুব দুঃখ-কষ্টেও বুক ফাটিয়ে চিৎকার করে কান্না-কাটি করা যাবে না। বড়লোকেরা কম কাঁদে। তারা শুধু ক্যামেরার সামনেই রুমাল হাতে কয়েক মিনিট অশ্রু বিনিয়োগ করে। এটাকে টিয়ার্স বলে।

 

কিছু দিনের মধ্যেই হয়ত ঘুম থেকে উঠে BTV চালিয়ে বা পত্রিকা হাতে নিয়ে দেখব মধ্যবিত্ত থেকে ধনী হয়ে গেছি। তখন তো বড়লোকরা যা করে আমাদেরকেও তাই করতে হবে। বড়লোকেরা কষ্টের সময় ক্যামেরার সামনে রুমাল হাতে দু-ফোটা অশ্রু বিনিয়োগ করে একটু পরেই আড়ালে কি সামনেই আবার স্মাইল করে।

 

ধনী হতে আমাদের বেশি দেরী নেই। আমাদের রুমাল হাতে অশ্রু বিসর্জন দেয়া শিখতে হবে না। কারন চলমান অশ্রুধারা থামার কোন সম্ভাবনা নেই। তবে আমরা এখন মধ্যবিত্ত, অভাব নেই বরং আমাদের প্রান্তিক আয়েশী জীবন চলছে। কিছুদিনের মধ্যেই আমরা বিদেশে যাকাত রফতানি করব। শুধু মধ্যবিত্ত থেকে ধনী হওয়ার সার্টিফিকেট হাতে পাওয়ার অপেক্ষায় আছি। তাই এখনি চেষ্টা করুন এই স্বজন হারানো তীব্র কষ্টের দিনে স্মাইল করতে পারেন কি না তাদের মত, যারা মানুষ না বরং...........।

Jakat Mymensingh-6i

 

দেশ যদি এভাবে কর্তব্যহীন কর্তার সস্তার কাগজে কলমে এগোতেই থাকে তাহলে এই উন্নয়নের জোয়ারে দেশে হয়ত একদিন আর মানুষ থাকবে না........... দেশের অভিশাপ হয়ে পরে থাকবে শুধুই জুতা।

 

 

লেখক পরিচিতি
এম, এইচ, মিনহাজ
আমি বিভিন্ন বাংলা/ইংরেজী ব্লগের একজন অনিয়মিত এবং সখের ব্লগার। তবে নিয়মিত লেখার ইচ্ছে থাকলেও অনিয়মিত ভাবেই পাঠকদের বিরক্ত করে থাকি। আমার লেখার বিষয়বস্তু- যা মনে আসে তাই। কারও কাছ থেকে বাহবা পাওয়ার জন্য লিখি না। কেউ আমার লেখা পছন্দ করলে খুশি হই তবে অপছন্দ করলেও লেখালেখি বন্ধ করার কোন অবকাশ নেই, কারন আমি একান্ত সখের বশেই লেখালেখি করি।
আমার ব্লগ সমুহ:

আপনার মতামত দিন