gdffdgdgএই তো বছর পাঁচেক আগের কথা। জেলা পর্যায়ে অনূর্ধ্ব-১৬ ক্রিকেট খেলায় সাতক্ষীরার হয়ে প্রথম মাঠে নেমেছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান। প্রতিপক্ষ মাগুরা জেলার দল। প্রথম দিনই আগুন ঝরল তাঁর বলে। পেলেন দুই উইকেট। খেলা চলাকালে স্থানীয় কোচ আলতাফ হোসেন ফোন করে মুস্তাফিজের বড় ভাই মোখলেসুর রহমানকে বাগেরহাটে ডেকে নেন। আলতাফ ফোনে বলেন, মুস্তাফিজ দারুণ খেলছে। তাঁকে আসতেই হবে। মাঠে বসে মোখলেসুরও দেখলেন ছোট ভাইয়ের দুর্দান্ত বোলিং। দেখে মুগ্ধ হলেন তিনি।

মুস্তাফিজের তখন আবদার ছিল একজোড়া নতুন জুতার। মোখলেসুর কথা দিলেন, পরের ম্যাচে তিন উইকেট নিতে পারলে ছোট ভাইটির আবদার পূরণ করা হবে। মুস্তাফিজ তাঁর নিশানা ভেদ করলেন। কুষ্টিয়ার বিরুদ্ধে পরের ম্যাচে ঝোলায় পুরলেন তিন উইকেট। মোখলেসুর পরদিন সানন্দে খুলনা শহর থেকে মুস্তাফিজকে কিনে দেন একজোড়া স্পাইক বুট। মুস্তাফিজের আনন্দ যেন আর ধরে না।

বয়সভিত্তিক এই জেলা পর্যায়ের টুর্নামেন্টটির বাছাই পর্বেই ঘটেছিল বেশ মজার এক ঘটনা। মোখলেসুরের বাইকে চেপে সাতক্ষীরার সরকারি কলেজ মাঠে বোলিংয়ের পরীক্ষা দিতে এসেছেন মুস্তাফিজ। মুস্তাফিজ একা নন, এসেছেন আরও অনেক উঠতি তরুণ। আশঙ্কায় খানিকটা কুঁকড়ে গেলেন তিনি। তাঁর মনে হয়েছিল, এত প্রার্থীর ভিড়ে পরীক্ষাই বুঝি দিতে পারবেন না। অবশেষে পালা আসে তাঁর। কিন্তু হালকা টেনিস বলে খেলে অভ্যস্ত মুস্তাফিজ কাঠের বল হাতে প্রথমেই ঘটালেন বিপত্তি। প্রথম কয়েকটি বল ঠিকমতো পিচেই ফেলতে পারলেন না। দৌড়ে এলেন বড় ভাই মোখলেস। খানিকক্ষণ সাহস দিলেন ছোট ভাইকে। তারপর আর পিছু ফেরা নয়। একের পর এক দুর্দান্ত বল করে তিনি তাক লাগিয়ে দিলেন নির্বাচকদের। একদম গত ম্যাচটার মতোই। অভিষেক ম্যাচের প্রথম ওভারেই মাশরাফি বল তুলে দিলেন তাঁর হাতে। আর প্রথম বলেই ওয়াইড। কিন্তু তার পরই তো হয়ে উঠলেন বিস্ময়! চার ওভারের স্পেলে ডট বলই ষোলোটা। অধিনায়ক আফ্রিদির দাবিমতো টি-টোয়েন্টি 'স্পেশালিস্ট' দলটির বিপক্ষে এমন পারফরম্যান্স তো বিস্ময় না জাগিয়ে পারে না।

কে এই নতুন বিস্ময়?

বড় ভাই মোখলেসুরের হাত ধরেই প্রথম খেলার মাঠে আসা। পড়াশোনায় অতটা মন তাঁর কখনোই ছিল না। বাসায় তো বলেই দিয়েছিলেন, আমার দ্বারা ওসব হবে না। তোমরা আর জোর করো না। এর পর থেকে ক্রিকেটই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। বড়েয়া মিলনি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে নেট প্র্যাকটিস করতেন মুস্তাফিজ। তাঁর তত্ত্বাবধান করতেন স্থানীয় কোচ আলতাফ। আলতাফই প্রথম ধরতে পেরেছিলেন মুস্তাফিজের ভেতরের ‘ধারটা’। হিরে চিনে নিয়ে ঘষামাজার কাজটি তিনি শুরু করে দেন। জেলা পর্যায়ে এসে মুস্তাফিজকে আরও পরিণত করে তুলতে পরিশ্রম করেন সাতক্ষীরার জেলা কোচ মুফাস্‌সিনুল ইসলাম। এলাকায় অবশ্য ‘তপু ভাই’ বলে পরিচিত তিনি। সকলের পরিশ্রমের প্রতিদান দিতে পেরেছেন মুস্তাফিজ। গত রাতের ম্যাচে তাঁর পারফরম্যান্সই বলছে সে কথা।

সাতক্ষীরার কালিগঞ্জ থানার তেঁতুলিয়া গ্রামে মুস্তাফিজদের বাড়ি। বাবা আবুল কাশেম গাজী, মা মাহমুদা খাতুন। চার ভাইয়ের মধ্যে সবার ছোট মুস্তাফিজ। কোনো ডাক নাম নেই তাঁর। বড় ভাই মুখলেস বলেন, ‘নাম ওর একটাই, মুস্তাফিজ।’ ছোটবেলা থেকেই বাঁহাতি তিনি। এমনকি প্রথম প্রথম নাকি ভাতও খেতেন বাঁ হাতেই। অনেক চেষ্টায় এই অভ্যাসটি পাল্টানো গেছে তাঁর। ছোটবেলা থেকে বাবা-মা আর বড়দের খুব মেনে চলতেন তিনি। খেলতে নামার আগেও ভোলেননি এই আদবকায়দা। ফোন করে বাবা-মা, বড় ভাই, স্থানীয় মুরব্বি ও কোচদের সঙ্গে কথা বলেছেন। সবার দোয়া ও আশীর্বাদ নিয়েই খেলতে নামেন তিনি।

তেঁতুলিয়া গ্রাম থেকে সাতক্ষীরা শহরের দূরত্ব প্রায় ৪০ কিলোমিটার। প্রায় প্রতিদিনই এতটা পথ পাড়ি দিয়ে প্র্যাকটিসে যেতেন মুস্তাফিজ। বড় ভাই মোখলেসুর, স্থানীয় কোচ আলতাফ ও জেলা কোচ তপু ভাইয়ের নিয়মিত পরিচর্যায় মুস্তাফিজ শাণিয়ে নিতে থাকেন নিজের ধার। যেই ধারের কাছে কচুকাটা হতে থাকে প্রতিপক্ষের একের পর এক খেলোয়াড়। জেলা পর্যায়ের পর খুব বেশি দিন তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়নি। ডাক পেয়ে যান খুলনার বিভাগীয় দলে খেলার। বছর তিনেক আগে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে ফাস্ট বোলিং ক্যাম্পে ট্রায়াল দিতে এসে কোচরা আর ছাড়েননি এই প্রতিভাকে। নিয়মিতই অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলেছেন। বল করতেন জাতীয় দলের নেটেও। গত বছর অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপেও আলো ছড়িয়েছিলেন এই পেসার। পেয়েছিলেন বাংলাদেশের পক্ষে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ নয় উইকেট।গত বছরের মে মাসে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরে বাংলাদেশ ‘এ’ দলেও স্থান পেয়েছিলেন মুস্তাফিজ। রীতিমতো চমক ছিলেন তিনি। প্রধান নির্বাচক ফারুক আহমেদ তখন সংবাদ মাধ্যমে বলেছিলেন, ‘অনূর্ধ্ব-১৯ দলের সেরা বোলার সে। হয়তো খুব বেশি ম্যাচ খেলেনি। তবে দারুণ সম্ভাবনা রয়েছে। তা ছাড়া আমাদের বাঁহাতি পেসারও দরকার।’

মুস্তাফিজ প্রথম শ্রেণিতে খেলা শুরু করেন গত বছর এপ্রিলে। এই তো ছয় মাস আগে অভিষেক হয়েছে ঘরোয়া এক দিনের ম্যাচে। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খুলনার হয়ে মাত্র আট ম্যাচ খেলেই পেয়েছেন ২৩ উইকেট। গড় ১৮.৯১, ইকোনমিক রেট ২.৬৮। আর লিস্ট এ-তে আবাহনীর পক্ষে ৫ ম্যাচে উইকেট ১২টি। গড় মাত্র ১১.৭৫, ইকোনমিক রেট ৩.৪৫। আন্তর্জাতিক ম্যাচের অভিষেকে তো রীতিমতো কাঁপন ধরিয়ে দিলেন পাকিস্তানি ব্যাটসম্যানদের। প্রথম ২ ওভারে দিয়েছিলেন মাত্র ৪ রান। পুরো স্পেল শেষে ২০ রান খরচ করে নিয়েছেন দুটি উইকেট। সাজঘরে ফিরিয়েছেন শহীদ আফ্রিদি ও মোহাম্মদ হাফিজের মতো দুজন ব্যাটসম্যানকে। বাংলাদেশ দলে বাঁহাতি একজন দুর্দান্ত পেসারের ক্ষুধাটা বেশ পুরোনো। অভিষেক ম্যাচের চোখ ধাঁধানো পারফরম্যান্স তাই ‘নতুন দিনের বাংলাদেশ’ দলে ভিন্ন এক মাত্রা যোগ করবে বলেই পূর্বাভাস দিচ্ছে।


আপনার মতামত দিন