জীবনের ছিড়া ডায়েরী আব্দুল হান্নান চুয়াডাংগা জেলার অন্তর্গত দামুড়হুদা থানার উত্তর চাঁদপুর গ্রামের অতি দরিদ্র পরিবারে আমার জন্ম।পিতা সামান্য বেতনে মাদ্রাসাতে শিক্ষকতার পাশাপাশি মসজীদের মুয়াজ্জিন এবংগ্রাম্য মোক্তবের শিক্ষকতার কাজ করতেন। সংসারটা ভালভাবে চালানোর জন্য টিউশনি ও করাতেন। আমরা পাঁচ ভাই তিন বোন,শৈশবেই দুই ভাই এক বোন মারা যায়।তিন ভাই দুই বোন,মা,দাদী সহ বড় একটি সংসার। উঠোপালার পর চাঁদপুর এসে আমার দাদা কোন জমি জায়গার মালিক হতে পারেনি।শুধু শুনতাম নোয়াখালী আমাদের অনেক জমি জায়গা আছে কিন্ত এখানেতো কিছুই নেই।

আমার মা ইন্ডিয়ার মেয়ে নানাদের অবস্থা ভালই ছিল অনেক সময় সাহায্য করলেও বর্ডার সীমাবদ্ধতার কারণে ইচ্ছা থাকলে ও সাহায্য করা সম্ভব হতোনা। আমি যখন প্রাইমারী স্কুলে ভর্তি হলাম তখন বোগল ছিড়া একটা শার্ট আর হাফ প্যান্ট পরে স্কুলে গেলাম।৷ আমার খুব মনে পড়ে আমি ফারুক ফ্যেরো পাগলা আর তেলার ছেলে মোহাম্মদ আলী একসাথে তখন থার্ড ছার ছিল জমাত মাষ্টার আমাদের ভরতি পরীক্ষা নিচ্ছে আমার এখনো মনে আছে ফ্যেরোকে বলেছিল চারটা মুরগীর কয়টা ঠ্যাঙ? ও বলেছিল ষোল টা ঠ্যাঙ ওকে বাদে আমাদের বড় ওয়ানের ভর্তি করলো। আমি ক্লাসে ফাস্ট হলাম আমার মেধা দেখে হেড স্যার আমাকে ক্লাস টু তে উঠায়ে দিলো, পরে পরীক্ষা দিলাম থ্রিতে উঠে সেকেন্ড হলাম এ ভাবেই সামনে এগুই। মনে হতো গ্রামের ভিতর সবচাইতে দরিদ্র আমিই।আমার পারিবারিক অবস্থা আমার শিক্ষকরা জানতেন। স্কুলে কোন সাহায্য আসলেই হেড স্যার এলাহী বক্স আগে আমাকে দিতেন। তবে আমি ক্লাসে বয়সে সবার ছোট ছিলাম।আস্তে আস্তে যখন তৃতীয় শ্রেনীতে উঠলাম তখন সংসারের অভাবটা ভালমত বুঝতে পারলাম। মনে হচ্ছে আমার আব্বা আর পেরে উঠছেননা।

আমাদের পড়াশুনার জন্য আব্বা বিভিন্ন জায়গায় সাহায্যের জন্য চিঠি পত্র লিখেন। নোয়াখালী আমার দাদির ভাইদের কাছে,তারা অবশ্য বড়লোক । আব্বার নামে প্রায়ই মানি অর্ডার পাঠাতো। এই ভাবেই চলছে আমি ক্লাস ফোরে উঠে আরো পরিবার সম্পর্কে সচেতন হলাম, ভাবলাম কিছু করার দরকার। আব্বার কাছে আমার নীচ ক্লাসের যারা পড়তো তাদেরকে আমিই পড়াতাম যাতে আব্বার চাপটা কমে।

বাড়ীতে আব্বা দোকান দিয়ে দিল। বেচাকেনাও ভালো হতো আমরা যখন স্কুলে যেতাম মা তখন বেচাকেনা করতো। আমি খুব দাদির ভক্ত ছিলাম, দাদি আমাকে মাঝেমাঝে পয়সা দিত আর বলতো ভাল করে পড়বি।

আমি ক্লাস ফাইভে যখন উঠলাম তখন হতে গ্রামে এবং বাজারে পিয়াজু,পাপড়,বেগুনী এগুলো ভেজে বিক্রি করা শুরু করলাম এতে নিজের লেখাপড়ার খরচটা হয়ে যায় সংসারেও কিছু দিতাম। সপ্তাহে দুইদিন হেড স্যারের কাছে ছুটি নিয়ে বাজারে কেনাবেচা করতে যেতাম।

এরপর যখন ষষ্ঠ শ্রেনীতে উঠলাম তখন আব্বা মাদ্রাসাতে ভর্তি করে দিল। আমি শুধু কোরআন পড়তে পারতাম, জের, জবর, পেশ ছাড়া ন্যাড়া আরবী প্রথম প্রথম পড়া খুব সমস্যা হতো, বেগমপুরের হুজুরতো ভর্তিই করবেনা, আনছার হুজুর বললেন সমস্যা নেই শেখান ও পারবে। আনছার হুজুর অবশ্য আমার সম্পর্কে জানতেন। নতুন নতুন কিছু বলতে পারিনা না বললেও হয়না, আনছার হুজুর তখন সুপার। সাহস করে বললাম হুজুর আমার পরিবারের অবস্থাতো জানেন, আব্বার এই মাষ্টারীতে চলেনা আমাকেও পরিশ্রম করতে হয়। অন্তত নিজের লেখা পড়ার খরচটাতো ইনকাম করতে পারবো।

আমি ছুটির দিনগুলোতে মানুষের ক্ষেতে দিনমজুর যায়,বয়সে ছোট ছিলাম দেখে অনেক গিরস্থালিরা পছন্দ করতোনা অবশেষে আমার কাজ দেখে তারা আমাকে ভালবাসতো। তখন ১০/১২ টাকা করে দিন হাজির যাক ওতে আমার লেখা পড়াটা চলতো, আবার সকাল সন্ধা প্রাইভেট পড়াইতাম ক্লাস প্রতি ১০ টাকা এগুলোতে যা হতো নিজের লেখা পড়ার খরচ চালিয়ে সংসারের জন্যেও মাঝে মাঝে দিতাম। তবে আমার জীবনের বড় অবদান আলিয়া বুবু স্কুল হতে যখন বাড়ী আসতাম বাড়ীতে খাবার না থাকলে বুবু ডেকে নিয়ে আমাকে খাওয়াতো, কোন দিন একটু বিরক্ত হতে দেখেনি।

বর্তমানে আমার যিনি শাশুড়ি উনার কাছ হতেও মাঝে মাঝে তরকারী চেয়ে আনতাম।আমার বাড়ীর আশে পাশের মানুষ গুলোর কাছে আমি বড়ই ঋনি।দোয়া করা ছাড়া তাদের ঋন শোধ করার ক্ষমতা আমার নেই।মাদ্রাসাতে দাখিল পরিক্ষা দেবার আগ পর্যন্ত আমি ছুটির দিন গুলোতে কামলা যেতাম আর বৃহষ্পতিবার এবং সোমবারে বাজারে ভাজা বিক্রি করতে যেতাম।আমার পুজি একটা লোহার কড়া একটা দাঁড়িপাল্লা, একটা চেঙারি আর একটা ফরাত দুটো সালার বস্তা আর একটা কাপড়ের থলে।বাজারে গিয়ে ধারে দোকান হতে আটা পিয়াজ, বেসন, ঝাল, মসলা তেল নিয়ে ভাজা বিক্রি করে পয়সা শোধ দিয়ে লাভটা নিয়ে বাড়ী আসতাম।

আমি যখন অষ্টম শ্রেনীতে তখন আমার ফুফাতো ভাই ণূরুল ইসলাম বয়সে আমার বড়ো আমার সাথেই পড়তো উনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ভর্তি হয়ে গেলেন।উনার দেখাদেখি আমিও স্বপ্ন দেখতে লাগলাম।

জীবনের ডায়রিতে অনেক কিছু এড়িয়ে যেতে হয় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য। জয় পরাজয় ব্যাথা বিরহ অনেক থাকতে পারে,জীবনে প্রেম বিরহ ভালবাসা অনেককিছু আসতে পারে তবে আমার মতো গরীব ঘরের ছেলের জন্য এ গুলো অরন্যে রোদন বৈ আর কিছু নয়।চাকুরীর আগে রক্তের আপনরা ব্যতিত কেউ আপন ছিলনা। আমার পাশের বাড়ীর বর্তমান দাদা শ্বশুর উনার একটা ছেলে শুধু মাদ্রাসা হতে দাখিল পাশ করেছিল, আর কারো পড়াশুনা হয়নি এই জন্য উনি আমার পড়াশুনার প্রতি খুব হিংসা করতো। আমার বাবাকে বলতো মিয়া তোমার ছেলেকে না পড়িয়ে মানুষের বাড়ী কাজে দিলেওতো কিছু টাকা হয়,আব্বা কিছুই বলতোনা কারণ উনি তখন গ্রামের মাতব্বর মসজীদের মোক্তব কমিটির মোড়ল কিছু বললে যদি মোক্তবের চাকরীটা চলে যায় এই ভয়তে আব্বা নিশ্চুপ থাকতো। আমি একটা জামা ইস্ত্রী করে পরলে উনার চোখে আর সহ্য হতোনা। তবে চাকুরীর পর নাতনী জামাই হবার সুবাদে সবচাইতে আমাকে বেশী ভালবাসতো।

চাকুরীর আগে দুই জায়গায় আমার বিবাহের প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল,বেকারত্বের কারণে কেউ রাজি হয়নি। আবার চাকুরীর পর তারাই আমার অনেক পা ডলেছে, অনেক কাছে আসতে চেয়ছে, আমার বর্তমান স্ত্রী সম্পর্ক অনেক নেতিবাচক কথা ওরা বলেছে, আমি বলেছি সে বয়স এখনো ওর হয়নি, ওর বিরুদ্ধে আমি কোন কথা শুনতে চাইনা।

আমি সম্ভবত তখন দশম শ্রেনীর ছাত্র, স্কুল হতে আসার পর বাড়ীতে তরকারী নেই। বড়শী ছিপ নিয়ে মাথাভাঙ্গায় মাছ ধরতে গেলাম আমার সাথে একজন সহপাঠী সমবয়সী ও ছিল,মাথাভাঙ্গার পানি তখন কানায় কানায় দুজনেই কিনারে বসে পুঁটিমাছ ধরছিলাম। হঠাৎ আমার হবু বৌ তখন মনে হয় টুতে পড়তে পারে,আমাদের মাছধরার জায়গা দিয়ে ওর হাস তাড়ানো শুরু, আমি বললাম এই এটা কি করলি? আর আমার সহপাঠী বললো এই মোস্তোর বৌ দেখবি? মোস্তো ওর দাদার নাম। খুব দুধর্ষ ছিল।

মেয়েটা বাড়ী গিয়ে আমার সহপাঠীর নামে কিছু না বলে আমার নামে ইনিয়ে বিনিয়ে বলে পারিবারিক ফ্যাসাদ শুরু হলো ওর দাদাতো এমনিই নাচনী বুড়ি তার উপর ঢোলের বাড়ী।আব্বা আমাকে দুটো থাপ্পড় দিলো,আমারও রাগ হলো আমি ওর দাদাকে বললাম তোর নাতনীরে আমি বিয়ে করবই দেখিস? এই জন্য বিয়ের সময় ওর দাদা বলেছিল মেলেটারী প্রতিশোধ নিলরে। ওর দাদা কিন্ত আমার সাথে বিবাহ দিতে চাইনি। যাক ও ব্যাপারে পরে আসবো, আমি যথারীতি ক্লাস করে যাচ্ছি, তখন আলেমের ছাত্র টেষ্ট পরীক্ষা হয়ে গেছে টেষ্টে প্রথম বিভাগ হয়েছে কদিন পরেই ফাইনাল।

মাদ্রাসা কদিনের জন্য ছুটি আমার মনটাও তখন ভালনা কারণ আমার আদরের ছোটভাই হোসাইন পাঁচবছর বয়স কীডনী অসুখে মারা গেছে। কি সুন্দর করে কথা বলোতো। আমার খুব ভক্ত ছিল,আমি ওর জন্য অনেক কেঁদেছি ।ওর মরার কদিন পরই মাদ্রাসা ছুটির জন্য আমি ভারতে নানা, খালাদের বাড়ী বেড়াতে গেলাম,সাথে নোট নিয়ে গেছি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় গুলো দেখি।দুদিন না যেতেই আমার মেজ ভাইটা খালার বাড়ী হাজির,মিয়া ভাই তুমি বাড়ি চলো তোমার আর্মিতে চাকুরীর জন্য যেতে বলেছে। বাড়ী আসলাম য‌শোর যা‌বো ভা‌লো একটা জামা ছিলনা কি গা‌য়ে দিয়ে যা‌বো,?

যাক অামার বন্ধু ম‌নির কাছ হ‌তে একচা পাঞ্জা‌বি নিলাম আমার ফুফাতো ভাই নুরুল এর প্যান্ট নি‌য়ে নুর ইসলাম ভাই এর সাথে যশোর ক্যান্টনমেন্ট আসলাম, প্রথমদিন প্রাথমিক পরিক্ষা হলো পাশ করলাম, রাত তখন নয়টা বা‌জে অামার সা‌থে অা‌রো অ‌নে‌কে অা‌ছে ।নুরুল ভাই অামা‌কে উনা‌দের লাই‌নে নি‌য়ে মাছ ভাত খাওয়া‌লো এই প্রথম অা‌র্মির খানা খেলাম, তারপর অামা‌দের বলাহ‌লো অাজ তোমরা যাও অাগামীকাল সকা‌লে অাসবা পরীক্ষা অা‌ছে,এখন ক্যান্টন‌মে‌ন্টেও থাকা যা‌বেনা কোথায় থাক‌বো? কয়জন সহপা‌টি এক‌ত্রে যু‌ক্তি ক‌রে য‌শোর শহ‌রে হো‌টে‌লে গি‌য়ে থাকলাম,সবাই ২৫টাকা ক‌রে ভাড়া দিলাম।প‌রের দিন অাসলাম।

দ্বিতীয় দিন আবার পরিক্ষা শুরু তাতেও পাশ করলাম সর্বশেষে মেডিকেল তাতেও পাশ করলাম।মনে হলো সব শেষ এবার চাকুরীটা মনে হয় হয়ে গেল,ওমা আবার পরীক্ষা এবার খুব কঠিন পরীক্ষা। নাইন বেংগলের সিও এসে প্রশ্ন দেখে বললো এদের জন্য এত কঠিন পরীক্ষা কেন? এরা মেডিকেল এপ্রুফ না? তখন ক্যাপ্টেন জীলানী বললো স্যার এদের সিরিয়াল নাম্বার দেবো এই জন্য এই পরীক্ষা।যাক পরীক্ষাতে প্রথম হলাম আমারদের সাতজনকে চুড়ান্ত সুপারিশ দিয়ে নিয়োগ পত্র হাতে দিল এবং তিনদিন পর আমাদের যশোর ক্যান্টনমেন্ট নবম বেংগলে জয়েন্ট দিল ওখানেই ট্রেনিং হবে।

বাড়িতে আসলাম কেউ বিশ্বাস করতে চায়না গরীব মানুষ যে‌, বিশ্বাসতো করেইনা নানান জন নানা ধরনের টিটকারি মারা শুরু করলো।কেউ ব‌লে আর্মি‌তে বাল‌তি টান‌বি,‌কেউ ব‌লে বাসন মাজবী ইত্যাদী।যাক অামার অাব্বা বিশ্বাস ক‌রেছ‌লি,অামা‌কে অ‌নেক সাহসও দি‌য়ে‌ছিল অাব্বা অামার জন্য কি কি লাগ‌বে সব ধর‌নের বাজার ক‌রে দি‌লেন।‌ তিন‌দিন পর প্র‌শিক্ষ‌নের জন্য চ‌লে অাসলাম। অামা‌দের সা‌থের ব্যাজটার ট্রে‌নিং এক সপ্তাহ হ‌য়ে গে‌ছে অামরা এক সপ্তাহ প‌রে জ‌য়েন্ট ক‌রে‌ছি। অামা‌দের রিসিভশন ক‌রে কাপড় চোপড় দেয়া হ‌লো তারপর চুল কাটা, ওহ সা‌ধের চুল‌রে শেষ একেবা‌রে বা‌টি ছাট। পর‌দিন হ‌তে প্র‌শিক্ষন শুর‌ু।

ভালই লাগ‌ছে ক‌ঠিন প্র‌শিক্ষন সকাল বেলা ১ টা পু‌রি ১০ টার সময় চা বির‌তি‌তে কখ‌নো সিঙ্গাড়া কোন‌দিন পিয়াজু,‌কোন‌দিন নিমকী কোন‌দিন অালুর বোকারা।দুপ‌রে তিনরু‌টি কা‌লো কা‌লো উকু‌নি পোকা অলা অার স্ববজ‌ি ডাল রু‌টি‌কে নৌকা বা‌নি‌য়ে খাওয়া তাও ভালই মজা লাগত।মা‌সে ৫৫০টাকা বেতন,৫০০টাকা বাড়ি পাঠাতাম ‌৫০টাকা নি‌জের খর‌চের জন্য রাখতাম।৬মাস টাকা গু‌ছি‌য়ে নাইন বেংগ‌লের টেইলার দি‌য়ে একটা প্যান্ট বানালাম, প্লা‌ষ্টি‌কের কেডস প‌রে রোলক‌লে যেতাম।পরে অবশ্য একটা ভালো কেডস কিনেছিলাম।

প্রশিক্ষন চলা কালেই আমার শ্রদ্ধেয় ওস্তাদ মওলানা নুরুল ইসলাম এবং তা জুল আমাকে দেখতে গিয়েছিল,আমার মনে আছে নাইন বেংগলের ক্যান্টিন হতে আমি বিরানী কিনে খাইয়ে ছিলাম।বাড়িতে সব সময় চিঠি লিখতাম,বাড়িতে মাঝে মাঝে মায়ের হাতের সেমাই রান্না আমার ভালো লাগত তাই চিঠিতে লিখলাম,আব্বা আর বড় দুলাভাই আমার সাথে দেখা করার জন্য এস ছিলো, তাদের সাথে দেখা করতে গেলাম চুল কাটা আর শরীরের অবস্থা দেখে উনাদের মনটা অবশ্য একটু খারাপ হয়ে গিয়েছিল।

৬ মাস প্রশিক্ষনের পর শপথ হলো,মনে করলাম এবার বাড়ি যাবো,এতদিন কখনো কোথাও থাকেনি,বাড়িতে সবার জন্য কেমন জানি খারাপ লাগে।সন্ ধা বেলা জানতে পারলাম আমাদেরকে চট্টগ্রাম ইবিআরসিতে অরিয়েন্টেশনে যেতে হবে, মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল।যাক ইবিআরসিতে গেলাম ওখানে তখন ষোল বেঙ্গলের কালার প্যারেড চলছিল ইবিআরসিকে সাজানোর জন্য লোকের প্রয়োজন আমরা তো ওখানে গেছি এখন আর কোন সমস্যা হবেনা।

একমাস পর ইবিআরসি হতে আবার যশোহরে আসলাম মনে করলাম এখন মনে হয় ছুটি যেতে পারবো না হলোনা আদেশ হলো ইউনিটে গিয়ে ছুটি যাবে। দুইদিন পর আমাদের ইউনিটে পাঠালো ওখান হতে আমরা পনের দিনের ছুটিতে বাড়ি গেলাম কি যে আনন্দ লাগছিল।কেনাকাটা বেশি করতে পারেনি কারণ বেতন পেয়েই টাকা বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম অতিরিক্ত কিছু টাকা ছিল ওটা দিয়ে যা পারলাম নিলাম।

তখন আমাদের এলাকার রাস্তাগুলো পাকা হয়নি গাড়ির ব্যবস্থাও তেমন ছিলনা হেটে হেটে বাড়ি আসছিলাম হঠাৎ ছাকা চাচাদের বাড়ির কাছে আমার ছোট বোন আর রজনীর সাথে দেখা ওরা স্কুলে যাচ্ছিল ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করলাম ওমা ওরা স্কুলে না গিয়ে আমার পিছে পিছে বাড়ি চলে আসলো।ঐ ঘটনার পর হতে ও আমার দেখলেই কেমন যেন সংকোচ বোধ করে কথা বলে ও আমাকে বললো ভাই ভালো আছেন? আমিও জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছিস? হ্যাঁ ভালো। বহুদিন পর বাড়ি ফিরে আসলাম, পাড়ার সবাই দেখতে আসলো। অনেকে অনেক রকম উপদেশ দেয়া শুরু করলো,অনেকে ভালো পোশাক পরে বেড়ানো টাকে কেমন যেন কটু দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো। হাজার হোক চাঁদপুরে এলাঙ্গী ন্যলোপাড়ার ভুতেরা বাস করে ওদের ভিতর হিংসা বেশি। গরীব ঘরের কোন ছেলে বড় হোক এটা ওরা চাইনা কি ভাবে মানুষের ক্ষতি করা যাবে এই চিন্তাটা ওদের বেশি।যাক পনের দিনের ছুটি গরীবদের যেমন বন্ধু হয় তেমন বন্ধুদের সাথে আনন্দ উল্লাস করে শেষ করলাম ফিরে আসলাম ক্যান্টনমেন্টে।

ইউনিটে আসার পর বেতন একটু বেশি প্রায় সাড়ে নয় শত টাকা বেতন পাই,আমার পরিবারের জন্য এটি অনেক।বাড়িতে আট শত করে পাঠাতে লাগলাম আমার পরিবারের জন্য যথেষ্ট।হঠাৎ আব্বার একটা চিঠি পেলাম মাদ্রাসার চাকরিটা আব্বা আর করতে পারবেনা, উনি যে পোষ্টে ছিলেন সরকার ঐ পোষ্টের শর্ত বাড়িয়ে দিয়েছে। আব্বাকে বললাম আপনাকে আর চাকরি করতে হবেনা চিন্তার ও দরকার নেই। কদিন পরেই পে স্কেলের বাড়তি টাকা পাঁচ হাজার পেলাম এই প্রথম পাঁচ হাজার টাকা একবারে হাতে নিলাম, তখন বিকাল চারটা বাজে কোম্পানি কমান্ডার দুদিনের ছুটি দিলেন টাকা বাড়িতে রেখে আসার জন্য। মনটা অনেক খুশি বাবা মায়ের হাতে এতগুলো টাকা তুলে দেব।জীবনে এটা ভূল ছিল না সঠিক ছিল জানিনা তবে বাবা মা ঐ সময় মনে করতো মাসে পাঁচ হাজার টাকা বেতন পাই আসলে বেতন পেতাম পনের কি ষোলশত টাকা।

যাক দিন ভালই চলছিল,সবাই এখন বিবাহের কথা বলে,রজনী কে আমার পছন্দ হারুন কে বললাম ওর সাথে বিবাহ করবো ওর বাবা মা কে জানা আমার বাড়িতেও সবাইকে জানালাম আমার মা তেমনটা রাজি হতে চাইনি পরে অবশ্য রাজী হয়েছে, আমি তখন ৪১ ফিল্ড এ্যাম্বুলেন্সে আর্মির প্রাথমিক চিকিৎসা ক্যাডার করছিলাম৷ ও তখন সবে মাত্র পঞ্চম শ্রেনীর ছাত্রী, আমি জানতামনা ওর সাথে আমার বিবাহ আজ হবে।

তবে বিবাহের কথা অনেকদিন হতে চললেও শর্তের সাথে মিলছিলনা, ওর ছোট কাকা বলছিল পাশাপাশি বাড়ী কেমন দেখাই? আবার ওর মায়ের কাছ হতেও তেমন কোন উত্তর পাচ্ছিলামনা, আমার একান্ত সহপাঠী হারুনকে বললাম তুই রজনীর মাকে ডাক আমি সরাসরি কথা বলবো, ও রজনীর মাকে সন্ধায় ওদের বাড়ীতে আমি থাকতেই ডাকলো, আমি ছালাম দিয়ে উনার কাছে সরাসরি মতামত জানতে চাইলে উনি খুব বিচক্ষনাতার সাথে আমার কথার উত্তর দিলেন। যাতে আমিও সন্তুষ্ট হলাম উনিও বললেন ইউনুছ বলেছে ঠিক আছে আমাদের সাথে জমি বদল করুক তাহলে বিবাহ দেয়া যাবে। বিষয়টি আব্বার কাছেও গেল, আমার আব্বা বিষয়টিতে সম্মত হলেন জমির পরিমান ও একটু বেশি এই জন্য। আবার মূল্যের দিক দিয়ে আমাদের জমির মূল্য বেশি।

সেদিন ছিল রমজানের ঈদের দিন, ঈদে যাবার আগেও জানিনা আমার আজ বিবাহ হবে, সকালে দেখলাম আমার হবু বৌটা শীলে বাটনা বাটছে দেখে ঈদে গেলাম। ঈদ পড়ে আসতেই আব্বার কথা হলো বড় হুজুরের সাথে, হুজুর বললেন আজ শুভদিন আজ বিবাহ হয়ে যাক। হুজুরের কথামত উভয় পরিবারের সম্মতিতে বিকালে বিবাহ সম্পন্ন হলো। বিবাহের দিন আত্মীয় স্বজনদের জন্য বাড়িতে জায়গা পেলামনা রজনীদের বাড়িতেই থাকতে হলো ।


আপনার মতামত দিন