গতানুগতিক জীবন থেকে মুক্তি দিয়ে পুরোবিশ্বকে এক সূতোয় গাঁথতেই যেন চার বছর পর পর ফিরে আসে ফুটবল বিশ্বকাপ। প্রতিবার বিশ্বকাপ আসে, মাতিয়ে তোলে মানবজীবন, রেখে যায় কিছু স্মৃতি। এসব স্মৃতির মাঝে আবার কিছু স্মৃতি থাকে, যা ওই বিশ্বকাপকে সারাজীবনের জন্য স্মরণীয় করে রাখে। আবার কিছু স্মৃতি থাকে, যা কোনো ব্যক্তি বিশেষের জীবনে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকে। এই যেমন ৮৬ এর বিশ্বকাপ, সে বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক ম্যারাডোনাকে মনে রাখবে আজীবন আর্জেন্টিনা এবং তার ভক্ত-সমর্থকরা।

wc cover

 

এবার আসা যাক, যেসব কারণে বিশ্বকাপ ফুটবল-২০১৪ স্মরণীয় হয়ে থাকতে পারে ব্যক্তি বিশেষ থেকে পুরো বিশ্বের মনে, সেগুলো প্রসঙ্গে।

 

১. যান্ত্রিক শক্তির জয়: প্রথমেই আসতে হবে এই প্রসঙ্গ। জার্মানি যান্ত্রিক ফুটবল খেলে- এটা সর্বজন বিদিত। কিন্তু সেই যান্ত্রিক ফুটবলেও যে সৌন্দর্য থাকে এবং লাতিন ফুটবলের সৌন্দর্যকে ম্লান করে দিয়ে তা যে বিশ্বকাপ জয় করে নিতে পারে, তার উদাহরণ হয়ে থাকবে এই বিশ্বকাপ। এর আগেও জার্মানি বিশ্বকাপ জিতেছে আরো তিনবার। তবে সেটা পশ্চিম জার্মানি। পুরো জার্মান জাতি এই প্রথমবারই বিশ্বকাপ জিতল।

wc1

বিশ্বকাপজয়ী জার্মান দল

 

২. রেকর্ডের প্রতিশোধ: ২০০৬ সালে জার্মান বিশ্বকাপে স্বাগতিক দেশের সাবেক ফুটবলার জার্ড মুলারের একক সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড ছিনিয়ে নেন ব্রাজিলের তৎকালীন কিংবদন্তি স্ট্রাইকার রোনাল্ডো। তারই যেন প্রতিশোধের টুর্নামেন্ট ছিল এই ব্রাজিল বিশ্বকাপ। রোনাল্ডোর একক সর্বোচ্চ গোল ১৫ কে ছাড়িয়ে ১৬ গোল করেন জার্মান স্ট্রাইকার মিরোস্লাভ ক্লোসা। এযেন জার্মানির রেকর্ড পূণরুদ্ধার মিশন।

wc2

সর্বোচ্চ একক গোলের রেকর্ড নিজের করে নেওয়ার পর ক্লোসা

 

৩. ক্যারিয়ারের সর্বশেষ এবং সর্বপ্রথম ম্যাচে বিশ্বকাপ জয়: এখানেই নাম আসবে প্রথমে মিরোস্লাভ ক্লোসার। এখন তার বংস ৩৬ চলছে। সহজ হিসেবে এটাই তার শেষ বিশ্বকাপ। শেষ হওয়াটা এতো সুন্দর আর কার দ্বারা সম্ভব হয়েছে, তা খুঁজে বের করতে রীতিমত ইতিহাস ঘাঁটা লাগবে। এদিকে ২২ বছর বয়সী মারিও গোটৎশের এটাই প্রথম বিশ্বকাপ। ক’জন খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ার এতো রঙিনভাবে শুরু হয়, তাও ভাবার বিষয়। শুধু কি তাই? বিশ্বকাপ ফাইনালে দলের পক্ষে জয়সূচক এবং একমাত্র গোলটিই এসেছে তার পা থেকে। এযেনে বর্ণাঢ্য এক ফুটবলের সূচনা!

wc3 1

জয়সূচক গোলের পর মারিও গোটৎশে, আনন্দ ভাগ করতে ছুটে আসছেন মুলার

 

৪. হ্যাট্রিক দিয়ে শুরু: পর্তুগালকে ৪ গোলে উড়িয়ে দেওয়ার ম্যাচে জার্মান স্ট্রাইকার থমাস মুলারের হ্যাট্রিক যেন জানান দিয়েছিলেন এবারের ফলাফল। এরচেয়ে ভালো শুরু আর কারো হয়েছে কি না, তা খুঁজে পেতেও ইতিহাস নিয়ে বসা লাগবে।

wc4

প্রথম রাউন্ডে পর্তুগাল বধ

৫. অবিশ্বাস্য সেমিফাইনাল: ২০১৪ বিশ্বকাপ যদি আর কোনো কারণে স্মরণীয় হয়ে না থাকে, তবুও সে স্মরণীয় হয়ে থাকবে অবিশ্বাস্য সেমিফাইনালের জন্য। ব্রাজিলকে ৭-১ গোলে রীতিমত বিধ্বস্ত করেছে বিশ্বকাপ জয়ী দল জার্মানি। এর আগে আর কোনো সেমিফাইনালে কোনো দলের এমন শোচনীয়ভাবে পরাজিত হওয়ার রেকর্ড নেই।

wc5

সেমিফানলের সেই অবিশ্বাস্য জয়ের পর জার্মানি

 

৬. ব্রাজিলের স্বাগতিক আতঙ্ক: এর আগে ১৯৫০ সালে ব্রাজিল ছিল বিশ্বকাপের আয়োজক। সেবার মারাকানায় উরুগুয়ের কাছে হেরে বিদায় নিতে হয় স্বাগতিকদের। সেই ঘটনার নাম হয়ে গেছে ইতিহাসে ‘মারাকানাজো’। এবার জার্মানির কাছে আবারো করুণ পরাজয়। এবার ঘটনাটা ঘটেছে মিনেইরোতে। এঘটনারও নামকরণ হয়ে গেছে ‘মিনেইরোজো’। এছাড়া এবার নেইমারের ইনজুরিও অনেকের মনে দাগ কেটে থাকবে অনেকদিন।

wc6

পরাজয়ের পর কান্না

 

৭. কামড় আতঙ্ক: ইতালির কিয়েলিনির ঘাড়ে কামড় দিয়ে ‘কামড় কাণ্ডে’র জন্ম দিয়েছেন উরুগুয়ের লুইস সুয়ারেজ। এ কাণ্ড এখন রীতিমত আতঙ্ক ফুটবল দুনিয়ায়। আর একারণেই হয়তো বার্সেলোনা প্রতিরক্ষাস্বরূপ আগেভাগেই বলে দিয়েছে- পরবর্তীতে সুয়ারেজ এমন কাণ্ড করলে তিন মিলিয়ন ডলার জরিমানা গুণতে হবে।

wc7

লুইস সুয়ারেজ

 

৮. হামেস রদ্রিগেজ: কলম্বিয়ান স্ট্রাইকার হামেস রদ্রিগেজের এটাই প্রথম বিশ্বকাপ। প্রথম বিশ্বকাপটা মারিও গোটৎশের মতো জয় করতে না পারলেও তিনি জয় করেছেন গোল্ডেন বুট। এবারের বিশ্বকাপের সবচেয়ে বড় নবাগত তারকা হিসেবে খুব দ্রুতই হামেস রদ্রিগেজের নাম উচ্চারিত হবে বলে সবাই আশা করছেন।

wc8

হামেস রদ্রিগেজ

 

৯. ট্র্যাজিক হিরো মেসি: আর্জেন্টিনার বাসিন্দা থেকে শুরু করে বিশ্বময় আর্জেন্টাইন ভক্ত-সমর্থক, এমনকি শত্রুও চেয়েছিলেন মেসি জয় করুক এবারের বিশ্বকাপ। প্রশংসার আতিশায্যে তাকে বলা হচ্ছিল- সে ভীন গ্রহের ফুটবলার। বিশ্বকাপ জয় তাকে বসাতে পারতো ফুটবল গ্রেট ম্যারাডোনার পাশেই। কিন্তু বিস্ময়বালকের চলা হল না আর একটা পা। থেমে গেলেন তিনি। থেমে গেল আর্জেন্টিনা। আর তাই সারাজীবন না হোক, অন্তত আগামী চার বছর এবারের বিশ্বকাপকে ফুটবল দুনিয়া মনে রাখবে ট্র্যাজিক হিরো ম্যাসির কারণেও।

wc9

লিওনেল মেসি

 

১০. গোলকিপারের বিশ্বকাপ: বলা হচ্ছে এবারের বিশ্বকাপটা মূলত গোলকিপারদের বিশ্বকাপ। তারা দেখিয়েছেনও দু’হাতে যাদুর কারিশ্মা। ওচোয়া থেকে শুরু করে ম্যানুয়েল নয়্যার- সবাই দলের জয়ে রেখেছেন অসামান্য ভূমিকা। এতালিকায় সবার ওপরেই থাকবেন হয়তো রোমেরো। আর্জেন্টিনা ফাইনালে এসেছেই তো তার কল্যাণে। সেমিফাইনালের প্যানাল্টি শ্যুটআউটে অমন দানবীয়ভাবে গোলবারে একাই দেয়াল তৈরি না করলে হয়তো নেদারল্যান্ডস ঝড়েই থেমে যেত মেসি বাহিনীর বিশ্বকাপ মিশন।

wc10

ওচোয়া, নুয়্যার ও রোমেরো

 

১১. সর্বোচ্চ গোলের বিশ্বকাপ: এবারের বিশ্বকাপে মোট গোল হয়েছে ১৭১, যা ২০১০ বিশ্বকাপের চেয়ে ২৬ গোল বেশি। এর আগে একমাত্র ১৯৯৮ বিশ্বকাপেই এতো গোল হয়েছে। সেবারও একই সংখ্যক গোল হয়েছে। এই হিসেবেও ইতিহাসের পাতায় বলা চলে স্থায়ী হয়ে গেছে এবারের বিশ্বকাপ।

goal

১. মেসি জাদুতে আর্জেন্টিনার বসনিয়া বধ ২. ফন পার্সির সেই উড়ন্ত গোল ৩. ক্লোসার ঘানা বধ

 

১২. প্রযুক্তর ছোঁয়া: এবারই প্রথম গোললাইন প্রযুক্তি ও কুলিং ব্রেকের ব্যবহার দেখেছে ফুটবল বিশ্ব। এছাড়া ম্যাজিক স্প্রে তো আছেই। ক্রিকেটের সাথে তাল মিলিয়ে ফুটবলও যে প্রযুক্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে- এযেন তারই উদাহরণ হয়ে থাকবে।

wc12

(সংগৃহীত)

 


আপনার মতামত দিন