ঈমানের পরীক্ষা আব্দুল হান্নান আজ আমরা যে ঈমানের কথা বলবো তা উম্মতে মুহাম্মদীয়ার সাথে সংশ্লিষ্ট ঈমানের কথা।একজন মানুষ ছোট থেকে যখন বড় হয় তখন পারিপার্শিক ভাবে তার ভিতর একটি বিশ্বাস এসে যায় এবং এই বিশ্বাসের উপর সে দাঁড়িয়ে থাকে।তেমনি ভাবে শত বছর ধরে জাজিরাতুল আরবের লোকেরা তাদের ভিতর একটা বিশ্বাস লালন করে আসছিলো।তারা অতিতের নবীদের প্রদত্ত আসমানী বিধান সমুহ ভুলে নিজেদের স্বার্থের পক্ষে যত নিয়ম কানুন আছে তার প্রচলন শুরু করেছিলো।পরিশেষে এমন একটা পর্যায় তারা পৌছে ছিলো যা ছিলো পাঁপের কঠিন অন্ধকার ময় মুহুর্ত। আল্লাহর অসীম রহমতে যে পাঁপিষ্ঠ পথ ভোলা মানুষদের সহজ সরল ও সঠিক পথের দিশা দেবার জন্য বিশ্বনবী মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ সঃ বিশ্বের বুকে মানব জীবনের জন্য চুড়ান্ত যে ফায়সালা নিয়ে এসছেন এবং মানুষের মাঝে যখন তা প্রচার করছিলেন তা তাদের মূল বিশ্বাসের উপর আঘাত হেনে ছিলো।এই জন্যই তারা এর বিরোধিতা করে আসছিলো।আল্লাহ প্রদত্ত প্রকৃত সত্যকে প্রতিষ্ঠার জন্য নুতন এই বিশ্ব নবীর সঃ সহচরদের বিরুদ্ধ বাদীদের কতৃক যে পরিস্থতি সৃষ্টি হয়েছিলো তার কথায় আমরা আলোচনা করবো। যে অবস্থায একথা বলা হয় তা ছিল এই যে, মক্কায় কেউ ইসলাম গ্রহণ করলেই তার ওপর বিপদ আপদ ও জুলুম- নিপীড়নের পাহাড় ভেঙ্গে পড়তো। কোন গোলাম বা গরীব মানুষ ইসলাম গ্রহণ করলে তাকে ভীষণভাবে মারপিট এবং কঠোর নির্যাতন-নিপীড়নের যাঁতাকলে নিষ্পেষিত করা হতো। সে যদি কোন দোকানদার বা কারিগর হতো তাহলে তার রুজি- রোজগারের পথ বন্ধ করে দেয়া হতো। সে যদি কোন প্রভাবশালী পরিবারের কোন ব্যক্তি হতো, তাহলে তার নিজের পরিবারের লোকেরা তাকে নানাভাবে হাসি তামাশা কটুক্তি ও বিরক্ত করতো ও কষ্ট দিতো এবং এভাবে তার জীবনকে দুর্বিসহ করে তুলতো। এ অবস্থা মক্কায় একটি মারাত্মক ভীতি ও আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে দিয়েছিল। এ কারণে লোকেরা নবী (সা) এর সত্যতার স্বীকৃতি দেয়া সত্ত্বেও ঈমান আনতে ভয় করতো এবং কিছু লোক ঈমান আনার ভয়াবহ শাস্তির সম্মুখীন হলে সাহস ও হিম্মতহারা হয়ে কাফেরদের সামনে নতজানু হয়ে যেতো। এ পরিস্থিতি যদিও দৃঢ় ঈমানের অধিকারী সাহাবীগণের অবিচল নিষ্ঠার মধ্যে কোন প্রকার দোদুল্যমানতা সৃষ্টি করেনি তবুও মানবিক প্রকৃতির তাগিদে অধিকাংশ সময় তাদের মধ্যেও একটা মারাত্মক ধরনের চিত্তচাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়ে যেতো। এ ধরনের অবস্থার একটা চিত্র পেশ করে হযরত খাব্বাব ইবনে আরাত তিনি বলেন, যে সময় মুশরিকদের কঠোর নির্যাতনে আমরা ভীষণ দুরবস্থার সম্মুখীন হয়ে পড়েছিলাম সে সময় একদিন আমি দেখলাম নবী (সা) কা'বাঘরের দেয়ালের ছায়ায় বসে রয়েছেন। আমি সেখানে উপস্থিত হয়ে নিবেদন করলাম, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি কি আমাদের জন্য দোয়া করেন না৷ একথা শুনে তার চেহারা আবেগে- উত্তেজনায় রক্তিমবর্ণ ধারণ করলো এবং তিনি বললেন, "তোমাদের পূর্বে যেসব মু'মিনদল অতিক্রান্ত হয়েছে তারা এর চাইতেও বেশি নিগৃহীত হয়েছে। তাদের কাউকে মাটিতে গর্ত করে তার মধ্যে বসিয়ে দেয়া হতো এবং তারপর তার মাথার ওপর করাত চালিয়ে দু'টুকরা করে দেয়া হতো। কারো আংগ-প্রত্যংগের সন্ধিস্থলে লোহার চিরুনী দিয়ে আঁচড়ানো হতো, যাতে তারা ঈমান প্রত্যাহার করে। আল্লাহর কসম, এ কাজ সম্পন্ন হবেই, এমনকি এক ব্যক্তি সান'আ থেকে হাদ্বারামাউত পর্যন্ত নিশঙ্ক চিত্তে সফর করবে এবং আল্লাহ ছাড়া আর কারো ভয় তার মনে থাকবে না।এ চিত্তচাঞ্চল্যকে অবিচল ধৈর্য ও সহিষ্ণুতায় রূপান্তরিত করার জন্য মহান আল্লাহ ওহী নাযি করে সাহাবীদেরকে বুঝান , ইহকালীন ও পরকালীন সাফল্য অর্জনের জন্য আমার যে সমস্ত প্রতিশ্রুতি রয়েছে কোন ব্যক্তি নিছক মৌখিক ঈমানের দাবীর মাধ্যমে তার অধিকারী হতে পারে না। বরং প্রত্যেক দাবীদারকে অনিবার্যভাবে ঈমানের পরীক্ষার চুল্লী অতিক্রম করতে হবেই। তাকে এভাবে নিজের দাবির সত্যতা পেশ করতে হবে।মক্কায় তখন এমন কিছু মানুষ ছিলো যারা নবীজির আদর্শ এবং কোরআনের শ্বাশত পয়গামে আকর্ষিত হয়ে মনে ইসলামকে ভালো বেসেছিলো কিন্ত তারা এটাকে শুধু মৌখিক স্বীকারের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে চেয়েছিলো।তাদের এ অবস্থার প্রেক্ষিতে আল্লাহ ওহী নাযিল করে জানিয়ে দিলেন যে, আমার জান্নাত এত সস্তা নয় এবং দুনিয়াতেও আমার বিশেষ অনুগ্রহ এত আয়াসলব্ধ নয় যে, তোমরা কেবলি মুখে আমার প্রতি ঈমান আনার কথা উচ্চারণ করবে আর অমনিই আমি তোমাদেরকে সেসব কিছুই দান করে দেবো। এসবের জন্য তো পরীক্ষার শর্ত রয়েছে। আমার জন্য কষ্ট বরদাশত করতে হবে। বিভিন্ন ধরনের নিপীড়ন নির্যাতন সহ্য করতে হবে, বিপদ-মুসিবত ও সংকটের মুকাবিলা করতে হবে। ভীতি ও আশঙ্কা দিয়ে পরীক্ষা করা হবে এবং লোভ লালসা দিয়েও। এমন প্রত্যেকটি জিনিস যা ভালোবাসো ও পছন্দ করো, আমার সন্তুষ্টির জন্য তাকে উৎসর্গ করতে হবে। আর এমন প্রত্যেকটি কষ্ট যা তোমাদের অনভিপ্রেত এবং তোমরা অপছন্দ করে থাকো, আমার জন্য তা অবশ্যই বরদাশত করতে হবে। তারপরেই তোমরা আমাকে মানার যে দাবি করেছিলে তার সত্য- মিথ্যা যাচাই হবে। কুরআন মাজীদের এমন প্রত্যেকটি জায়গায় যেখানে বিপদ- মুসিবত ও নিগ্রহ- নিপীড়নের সর্বব্যাপী আক্রমণে মুসলমানদের মধ্যে ভীতি সঞ্চারের অবস্থা হয়ে গেছে সেখানেই একথা বলা হয়েছে।সাহাবীরা রাঃ আল্লাহর এ সমস্ত নির্দেশনা সবকিছু ত্যাগের বিনিময়ে মেনে নিয়েছিলো।হিজরাতের পরে মদিনায় মুসলমানদের জীবনের প্রথমাবস্থায় যখন অর্থনৈতিক সংকট , বাইরের বিপদ এবং ইহুদী ও মুনাফিকদের ভিতরের দুষ্কৃতি মু'মিনদেরকে ভীষণভাবে পেরেশান করে রেখেছিল তখন আল্লাহ বলেনঃ "তোমরা কি মনে করেছো তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করে যাবে, অথচ এখনো তোমরা সে অবস্থার সম্মুখীন হওনি, যে অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তী গণ ৷ তারা সম্মুখীন হয়েছিল নির্মমতা ও দুঃখ- ক্লেশের এবং তাদেরকে অস্থির করে তোলা হয়েছিল।এমনকি রসূল ও তার সাথে যারা ঈমান এনেছিল তারা চিৎকার করে বলে উঠেছিল আল্লাহর সাহায্য কবে আসবে? তখনি তাদেরকে ওহীর মাধ্যমে বলা হলো জেনে রাখো, আল্লাহর সাহায্য নিকটেই। অনুরূপভাবে ওহোদ যুদ্ধেও পর যখন মুসলমানদের ওপর আবার বিপদ- মুসিবতের একটি দুর্যোগপূর্ণ যুগের অবতারণা হয় তখন বলা হয়ঃ" তোমরা কি মনে করে নিয়েছো, তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করে যাবে, অথচ এখনো আল্লাহ দেখেনইনি যে, তোমাদের মধ্য থেকে কে জিহাদে প্রাণ উৎসর্গকারী এবং কে সবরকারী ৷মহান আল্লাহ মুসলমানদের মনে এ সত্যটি গেঁথে দিয়েছেন যে, পরীক্ষাই হচ্ছে এমন একটি মানদণ্ড যার মাধ্যমে ভেজাল ও নির্ভেজাল যাচাই করা যায়। ভেজাল নিজে নিজেই আল্লাহর পথ থেকে সরে যায় এবং নির্ভেজালকে বাছাই করে নিয়ে নেয়া হয়। আমরা যদি দুনিয়ার জীবনের পরিক্ষার কথা চিন্তা করি তাহলে দেখবো পরিক্ষার জন্য চাঁদা সবাই দিলেও পরিক্ষার সময় যখন আসে তখন কিন্ত ফেল করার ভয়ে অনেকেই পরিক্ষা দিতে যায়না।অনেকে পরিক্ষা দিতে গেলেও সব পরিক্ষা দেয়না,আবার অনেকে পরিক্ষার হল হতে বহিস্কার হয়ে যায়।যারা পরিক্ষা সম্পন্ন করে তাদের ভিতর আবার সবাই পাশ করেনা,পাশ কারীদের ভিতর আবার শ্রেনী বিন্যাস থাকে।ঈমানের পরিক্ষার ময়দানটাও অনুরূপ,নিজেদের স্বার্থের যদি ক্ষতি না হতো তাহলে প্রত্যেকটা মুনাফিক প্রথম শ্রেনীর ঈমানদার হয়ে যেত।মুনাফেকরা নবীজির সুরে কথা বলতো,নবীজির ন্যায় মসজিদে গিয়ে নবীজির সাথে নামাজ পড়তো নবীজির সাথে দাওয়াতে যেত কিন্ত মুনাফেকরা যখনই দেখলো যে মুহাম্মদ সঃ যে ইসলামের দিকে আহবান করছে এখানে নিজেদের স্বার্থ বিন্ষ্ট হবে অতএব এ দাওয়াতে মুহাম্মদের সহচরদের ধোকা দিতে হবে।ঈমানের পরিক্ষায় তারা পাশ করে নাই।একটা বিষয় মনে রাখতে হবে তাহলো ছাত্র যত বড় তার পরিক্ষা কিন্ত তত বড়।পঞ্চম শ্রেনীর ছাত্রকে কিন্ত কখনো দশম শ্রেনীর পরিক্ষা নেয়া হবেনা,আমাদেরকে ও কিন্ত ঈমানের পরিক্ষা দিতে হবে তবে নবী রাসুল ও সাহাবীদের ন্যায় কষ্টের ঈমানী পরিক্ষা নেয়া হবেনা।তিনাদের মাকাম যেমন বড় তিনাদের পরিক্ষাও তেমন বড় ছিলো, তবে কিছু ব্যক্তি বিশেষকে কঠিন পরিক্ষার সম্মুখীন হতে পারে এটা অস্বাভাবিক কছিু নয় ।মুসলমান সকলকেই ঈমানের পরিক্ষায় পাশ করতে হবে , আার কিয়ামতের আগ পযর্ন্ত প্রত্যেক যুগের প্রত্যেক মুসলমানের উপর ঈমানের পরিক্ষা সংঘটিত হবে।আমাদের ঈমানের পরিক্ষার ধরন সমুহ কেমন হতে পারে? আপনি অনেক ব্যস্ত মানুষ, তারপরেও আপনি নামাজ পড়েন কিনা এটা ব্যস্ততা দিয়ে আল্লাহ হইত আপনাকে পরিক্ষা করছেন।আপনার অধিনে অনেক মানুষ থাকে আপনি তাদের প্রতি ন্যায় বিচার করেন কিনা?তাদেরকে সৎ পথে চলার জন্য আপনি প্রেষনা দেন কিনা?তাদেরকে নামাজ পড়তে বলেন কিনা এগুলো আপনার জন্য পরিক্ষা হতে পারে।আপনার হাতে সরকারী বা মালিকের অর্থ বিত্ত আত্মসাৎ করার সুয়োগ আছে আপনি কি বিরত থাকেন? না আত্মসাৎ করেন? এগুলো আপনার জন্য পরিক্ষা।আল্লাহ আপনাকে শিক্ষকতার পেশা দিয়েছেন,আপনি কি ছাত্র ছাত্রীদের ভালো করে পড়ান ? না কি টাকা ইনকামের ধান্দায় থাকেন, ফেলের হুমকী দিয়ে নিজের কাছে প্রাইভেট পড়তে বাধ্য করে এটা আপনার জন্য পরিক্ষা।আল্লাহ আপনাকে ডাক্তার বানিয়েছেন আপনি কি ইমানদারী রোগী সেবা করেন? না কি ক্লিনিকে টাকা ইনকামের পথ বের করেন এটা ডাক্তারদের জন্য পরিক্ষা।প্রত্যেকটা পেশার ভিতরে পেশাদারের জন্য সঠিভাবে দায়িত্ব পালন করাটাও একটা ঈমানের পরিক্ষা।আপনি একটা পরিবারের মালিক আপনার পরিবারটা সঠিকভাবে পরিচালনা করাটাও আপনার জন্য পরিক্ষা।পরিবারকে হালাল রুজি খাওয়ানো,সঠিক আকিদা শিক্ষা দেয়া, পরিবারকে পর্দায় রাখা, মেয়েদের পর্দা পুশিদা শিক্ষা দেয়া,সন্তানদের সঠিক পথে পরিচালনা করাটাও ঈমানের পরিক্ষার ভিতর শামিল।রোগ শোক, বালা মছিবত বিপদ আপদ,ক্ষতি,জুলুম নির্যাতন এ সব কিছু আল্লাহর পক্ষ হতে এক ধরনের পরিক্ষা।এ সমস্ত পরিক্ষায় বিচলিত না হয়ে আমি আপনি কতটুকু আল্লাহর স্বরন রাখি আল্লাহ পথে কতটুকু থাকি এটাই আল্লাহর পরিক্ষা।
আপনার মতামত দিন