পরপর তিন বলে ৩টি উইকেট। হ্যাটট্রিক!ক্রিকেটে যেকোনো বোলারের জন্য এক স্বপ্নের মতো ব্যাপার। সেই স্বপ্ন কারোজীবনে সত্যি হয়, কারো হয় না। ১৯৭১ সালে শুরু হয় ওয়ানডে ক্রিকেট খেলা। আর গত২৯ অক্টোবর ২০১৩ তারিখে বাংলাদেশ ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যকার খেলায় রুবেলহোসেনের হ্যাটট্রিকের মধ্য দিয়ে তিন হাজারের অধিক ওয়ানডে ক্রিকেট ম্যাচেহ্যাটট্রিক হয়েছে মাত্র ৩৪টি। ওয়ানডে ক্রিকেটের হ্যাটট্রিক নিয়েই আজকেরখেলার চমক। ১১ বছরের অপেক্ষা ১৯৭১ সালের ৫জানয়ারি মেলবোর্নে অস্ট্রেলিয়া-ইংল্যান্ডের ম্যাচ দিয়ে পথচলা শুরু ওয়ানডের।এরপর ১১ বছর আর ১৫৭ ম্যাচ কেটে গেলেও হ্যাটট্রিকের দেখা পায়নি সীমিতওভারের ম্যাচ। প্রতীক্ষার অবসান ১৯৮২ সালে, ১৫৮তম ম্যাচে। সিন্ধুর নিয়াজস্টেডিয়ামে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে প্রথম হ্যাটট্রিকটি করেন পাকিস্তানেরফাস্ট বোলার জালাল উদ্দীন। শুরুটা রড মার্শকে বোল্ড করে। পরের বলে ব্রুসইয়ার্ডলি ক্যাচ তুলে দেন উইকেটের পেছনে ওয়াসিম বারিকে আর তৃতীয় বলে জিওফলসনকে বোল্ড করে ওয়ানডের নতুন ইতিহাস গড়েন জালাল। ম্যাচটিতে ৩২ রানে ৪উইকেট নিয়ে ৫৯ রানের জয়ও এনে দেন পাকিস্তানকে।

সবাইকে ছাড়িয়ে পাকিস্তান ৩৪টিহ্যাটট্রিকের মধ্যে পাকিস্তানি বোলাররাই এই কীর্তি করেছেন আটবার। ওয়াসিমআকরাম, সাকলায়েন মুশতাক করেছেন আবার দু’বার করে। তবে ২০০২ সালে মোহাম্মদসামির পর আর কোনো পাকিস্তানি হ্যাটট্রিক পাননি ওয়ানডেতে। পাকিস্তানের পরদ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাতটি হ্যাটট্রিক আছে শ্রীলঙ্কার বোলারদের। এ ছাড়াঅস্ট্রেলিয়ার পাঁচটি, ইংল্যান্ড ও বাংলাদেশের তিনটি, ভারত, নিউজিল্যান্ড ওওয়েস্ট ইন্ডিজের দু’টি আর একটি করে হ্যাটট্রিক আছে দক্ষিণ আফ্রিকা ওজিম্বাবুয়ের বোলারদের। অর্থাৎ টেস্ট খেলা ১০ দলেরই অন্তত একটি করে হলেওহ্যাটট্রিক আছে ওয়ানডেতে।

বাংলাদেশের তিন জন বাংলাদেশেরতিনটি হ্যাটট্রিকের দু’টিই আবার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। প্রথমটি ২০০২ সালেরআগস্টে হারারেতে। গর্বের কীর্তিটা ফাস্ট বোলার শাহাদাত হোসেনের। শুরুটা৩৯তম ওভারের তৃতীয় বলে মুফাবিসিকে উইকেটের পেছনে খালেদ মাসুদের ক্যাচবানিয়ে। অফস্টাম্পের অনেক বাইরের বল তাড়া করতে গিয়ে ক্যাচ দিয়েছিলেন তিনি।পরের বলটা ইয়র্কার দিয়ে এলটন চিগুম্বুরাকে এলবিডাব্লিউ করে শাহাদাত জাগিয়েতোলেন বিরল সেই অর্জনের প্রত্যাশা। সেটা পূরণও হয় ওভারের পঞ্চম বলে, প্রসপার উতসেয়া উইকেটের পেছনে খালেদ মাসুদকে ক্যাচ দিয়ে ফিরলে। তবেশাহাদাতের হ্যাটট্রিকের পরও ওই ম্যাচে ২ উইকেটে হারতে হয়েছিল বাংলাদেশকে।শেষ ওভারে জয়ের জন্য জিম্বাবুয়ের দরকার ছিল ১৭ রান। কিন্তু মাশরাফি দিয়েবসেন ১৯! গত বছর এই ডিসেম্বরেই সেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই মিরপুরেহ্যাটট্রিক করেন আবদুর রাজ্জাক। ৪৫তম ওভারের শেষ বলে উতসেয়া ক্যাচ তুলেদিয়েছিলেন নাঈম ইসলামকে। এরপর ৪৭তম ওভারের প্রথম বলে রেমন্ড প্রাইস আরদ্বিতীয় বলে এমপফুকে এলবিডাব্লিউর ফাঁদে ফেলেন বাঁ-হাতি এই স্পিনার। সেবারঅবশ্য হারতে হয়নি। ম্যাচসেরা রাজ্জাক ৩০ রানে ৫ উইকেট নেওয়ায় ১৯১-এ গুটিয়েগিয়েছিল জিম্বাবুয়ে আর বাংলাদেশ জিতেছিল ৬ উইকেটে।

গত ২৯ অক্টোবর মিরপুরশেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে প্রথমওয়ানডেতে রুবেল টানা তিন বলে ফিরিয়ে দেন কোরি অ্যান্ডারসন, ব্রেন্ডনম্যাককালাম ও জেমস নিশামকে। হ্যাটট্রিকের আগে রুবেল যখন বল হাতে পানবাংলাদেশ তখন বেশ চাপের মুখে। বৃষ্টির পর নিউজিল্যান্ডের পুনঃনির্ধারিতলক্ষ দাঁড়ায় ৩৩ ওভারে ২০৬ রান। অর্থাৎ বাকি ১৩ ওভারে করতে হবে ১২৪ রান। সবমিলিয়ে ২৬ রানে রুবেলের শিকার ৬টি। ওয়ানডেতে বাংলাদেশের পক্ষে এটাই সেরাবোলিং। তবে এককভাবে নয়, যৌথভাবে। ২০০৬ সালে নাইরোবিতে কেনিয়ার বিপক্ষেমাশরাফি বিন মুর্তজাও ২৬ রানে ৬ উইকেট নিয়েছিলেন। বিশ্বকাপে সাতবার ওয়ানডেরসবচেয়ে মর্যাদার মঞ্চ বিশ্বকাপ। আর এই আসরেই কীর্তিটা হয়েছে সাতবার। প্রথমতিনটি আসরের হ্যাটট্রিক-খরাটা চেতন শর্মা দূর করেন ১৯৮৭ বিশ্বকাপে নাগপুরেনিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টানা ৩ বলে ৩ উইকেট নিয়ে। ৪২তম ওভারের খেলা চলছিলতখন। চতুর্থ বলে রাদারফোর্ডকে বোল্ড করে শুরু স্বপ্নের সেই অভিযানের। পঞ্চমবলে বোল্ড করেন ইয়ান স্মিথকে। ওভারের শেষ বলেও বোল্ড, সেবার শিকারচ্যাটফিল্ড। এভাবে হ্যাটট্রিক করে নতুন ইতিহাসই গড়েন চেতন শর্মা।বিশ্বকাপের প্রথম হ্যাটট্রিক তাও আবার তিনজনকেই বোল্ড করে! ১০ ওভারে ৫১ রানদিয়ে এই ৩টি উইকেটই পেয়েছিলেন তিনি। ১৯৯৬ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম হ্যাটট্রিক পেয়েছিলেন সাকলায়েন মুশতাক। সেইজিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই নিজের দ্বিতীয় হ্যাটট্রিক করেন ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সুপারসিক্সে। একমাত্র বোলার হিসেবে ইনিংসের প্রথম ওভারের প্রথম ৩ বলেহ্যাটট্রিকের কীর্তিটা কেবল চামিন্ডা ভাসের। পোর্ট এলিজাবেথে ২০০৩বিশ্বকাপে এই হ্যাটট্রিকে বাংলাদেশকে দুঃস্বপ্নের এক সকাল ‘উপহার’ দেনসাবেক এই লঙ্কান পেসার। ভাসের প্রথম বলেই ড্রাইভ করতে গিয়ে বোল্ড হয়ে যানবাংলাদেশী ওপেনার হান্নান সরকার। দ্বিতীয় বলে মোহাম্মদ আশরাফুল ফিরতি ক্যাচতুলে দেন ভাসেরই হাতে। আর তৃতীয় বলে দ্বিতীয় স্লিপে মাহেলা জয়াবর্ধনেরহাতে ক্যাচ তুলে দেন এহসানুল হক। এভাবেই প্রথম ওভারের প্রথম ৩ বলেহ্যাটট্রিক করে ইতিহাস গড়েন চামিন্ডা ভাস। এক বল বিরতির পর সানোয়ারহোসেনকেও এলবিডাব্লিউ করেছিলেন তিনি। ভাসেরই স্বদেশী লাসিথ মালিঙ্গা২০০৭ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টানা ৪ বলে ৪ উইকেট নিয়ে গড়েন নতুনকীর্তি। ম্যাচ জিততে শেষ ৬ ওভারে তখন দরকার মাত্র ৪ রান, হাতে ৫ উইকেট।৪৫তম ওভারের পঞ্চম বলে শন পোলককে বোল্ড আর ষষ্ঠ বলে অ্যান্ড্রু হলকে তিনিফেরান থারাঙ্গার ক্যাচ বানিয়ে। ৪৭তম ওভারের প্রথম বলে জ্যাক ক্যালিসসাঙ্গাকারাকে ক্যাচ দিলে হ্যাটট্রিক হয়ে যায় মালিঙ্গার। পরের বলে মাখায়াএনটিনিকে বোল্ড করে ডানহাতি ফাস্ট বোলার তো জিতিয়েই দিচ্ছিলেন লঙ্কানদের। ৫উইকেটে ২০৬ থেকে দেখতে দেখতেই ৯ উইকেটে ২০৭ রানে পরিণত হয় প্রোটিয়ারা। তবেমালিঙ্গার বলেই রবিন পিটারসন বাউন্ডারি মারলে ৮ বল বাকি থাকতে ১ উইকেটেররুদ্ধশ্বাস জয় পায় গ্রায়েম স্মিথের দল। বিশ্বকাপ ইতিহাসে একমাত্র বোলারহিসেবে মালিঙ্গা দু’টি হ্যাটট্রিকের রেকর্ড গড়েন সর্বশেষ আসরে, কেনিয়ারবিপক্ষে। নিজের সপ্তম ওভারের শেষ বলে এলবিডাব্লিউ করেছিলেন তন্ময় মিশ্রকে।পরের ওভারের প্রথম বলে পিটার অনগন্ডো বোল্ড। পরের বলে শেন গোচেরও স্টাম্পউড়িয়ে হ্যাটট্রিক।

এ ছাড়া বিশ্বকাপে হ্যাটট্রিক আছে অস্ট্রেলিয়ার ব্রেট লিআর ওয়েস্ট ইন্ডিজের কেমার রোচের। অনন্য মালিঙ্গা একমাত্রবোলার হিসেবে ওয়ানডেতে তিন তিনটি হ্যাটট্রিকের নজির কেবল লাসিথ মালিঙ্গার।২০০৭ বিশ্বকাপে দক্ষিণ আফ্রিকা আর গত আসরে কেনিয়ার পর অস্ট্রেলিয়ারবিপক্ষে পরপর ৩ বলে ৩ উইকেট নিয়ে এই কীর্তি গড়েন তিনি। ওয়ানডেতে দু’বার করেএই কীর্তি গড়েছেন ওয়াসিম আকরাম, সাকলায়েন মুশতাক আর চামিন্ডা ভাস।ওয়ানডেতে তিনবার করলেও টেস্টে এখনো হ্যাটট্রিক পাননি মালিঙ্গা। টেস্ট আরওয়ানডেতে হ্যাটট্রিক করতে পেরেছেন শুধু পাকিস্তানের ওয়াসিম আকরাম ওমোহাম্মদ সামি। স্পিনার মাত্র দু’জন : বিস্ময়কর বৈকি! ওয়ানডেতেহ্যাটট্রিক করা বোলারদের মধ্যে স্পিনার মাত্র দু’জন। পাকিস্তানের স্পিনারসাকলায়েন মুশতাক ১৯৯৬ ও ১৯৯৯ সালে এই সাফল্য পান জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে। সেইজিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই বাংলাদেশের বাঁ-হাতি স্পিনার আবদুর রাজ্জাকওহ্যাটট্রিক করেছেন।  


আপনার মতামত দিন